মাসায়েল ও প্রশ্নোত্তর 4

অধ্যায়ঃ রোজা সংক্রান্ত মাসায়েল

 রোজা রাখা এবং ভঙ্গে চাঁদের হুকুম

চাঁদ দেখে রোজা রাখা ও চাদ দেখে রোজা ভঙ্গ করা :-

ইমাম বোখারি, মুসলিম ও অন্যন্য হাদিস বিশারদরা বর্ণনা করেছেন,

أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "إذا رأيتم الهلال فصوموا وإذا رأيتموه فأفطروا فإن غم عليكم فاقدروا له" [أخرجه البخاري رقم 1900، ومسلم رقم 1080/8].

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা চাঁদ দেখতে পেলে রোজা রাখবে আবার চাঁদ দেখতে পেলে রোজা ভঙ্গ করবে। আর আকাশ (মেঘাচ্ছন্ন হয়ে) ঢেকে থাকলে গণনা করবে।
(বোখারি ১৯০০ ও মুসলিম ৮/১০৮০)

ইমাম আহমাদ ও ইমাম নাসায়ি রহ. আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

"لا تصوموا حتى تروا الهلال ولا تفطروا حتى تروه"

চাঁদ না দেখে তোমরা রোজা রাখবে না আবার চাঁদ না দেখে ইফতার (ভঙ্গ) করবে না।

ইমাম তাবারানী রহ. তালক্ব বিন আলী রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন,

"أن الله جعل هذه الأهلة مواقيت فإذا رأيتموه فصوموا وإذا رأيتموه فأفطروا" [أخرجه الطبراني في معجمه الكبير 8/397 رقم 8237].

আল্লাহ তাআলা এ চাঁদসমূহকে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারক হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং তোমরা তা দেখতে পেলে রোজা পালন করবে আবার দেখতে পেলে ভঙ্গ (ইফতার) করবে। (আল মু’জাম আল কাবির)

وروى الحاكم عن ابن عمر رضي الله عنهما: "جعل الله الأهلة مواقيت للناس فصوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته" [أخرجه الحاكم في المستدرك 1/423 وأحمد في المسند 4/ 23 والدارقطني في سننه 2/163 وقال الحاكم: صحيح على شرط الشيخين ووافقه الذهبي].

ইমাম হাকেম রহ. ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা চাঁদসমূহকে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারক বানিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তা দেখে রোজা রাখবে আবার তা দেখেই রোজা ভঙ্গ করবে।
[হাকেম/আল মুস্তাদরাক:১/৪২৩, আহমাদ/আল-মুসনাদ:৪/২৩, দারাকুতনী/সুনান:২/১৬৩, ইমাম হাকেম একে ইমাম বোখারি ও ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন। ইমাম যাহাবী এর সমর্থন করেছেন।]


▪ রোজার ফরয ও রোজার শর্তসমূহ


রোজার কিছু মৌলিক আচার আছে। যা ফরজ বলে চিহ্নিত। সুস্থ-সবল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। কিন্তু শারীরিক অসমর্থতার কারণে সে এ দায়িত্ব থেকে আপাতভাবে মুক্তি পেতে পারে। এর প্রতিবিধানে রয়েছে কাজা ও কাফফারার বিধান। নিচে রোজার ফরজ ও শর্তগুলো দেওয়া হলোঃ-

রোজার ৩ ফরজ :
➖➖➖➖➖➖
১) নিয়ত করা

২) সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা

৩) যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা।

রোজা রাখার শর্ত :
➖➖➖➖➖➖
বান্দার প্রতি রোজা ফরজ হওয়ার জন্য যে শর্তগুলো থাকা আবশ্যক তা হলো-

১) মুসলিম হওয়া। অমুসলিমের ওপর রোজার বিধান প্রযোজ্য নয়;;

২) প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ওপর রোজা ফরজ নয়;

৩) জ্ঞানবান হওয়া। অর্থাৎ মস্তিষ্ক বিকৃত (পাগল) লোকের ওপর রোজা ফরজ নয়;

৪) নারীদের হায়েয তথা ঋতুস্রাব এবং নিফাস (সন্তান জন্মদান পরবর্তী সময়) থেকে পবিত্র থাকা। কারণ নারীরা হাফেজ ও নিফাস চলাকালীন সময়ে অপবিত্র থাকে। আর অপবিত্র থাকা অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। নারীদের হায়েজ ও নিফাসের কারণে যে কয়টা রোজা ভঙ্গ হবে; ওই রোজাগুলো পরবর্তী সময়ে আদায় করে নিতে হবে। উত্তম হলো পরবর্তী বছর রমজান আসার আগেই তা আদায় করা।

৫) রোজা পালনে  সামর্থবান হওয়া।

মুসাফির না হওয়া। কারণ মুসাফিরের জন্য রোজা ফরজ নয়।


▪ রোযার নিয়তের মাসয়ালা


১. নিয়ত করার অর্থ মনে মনে এরাদা করা, মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরী নয়, শুধু মনের মধ্যে ইচ্ছা করাই যথেষ্ট। বরঞ্চ সেহরি খাওয়াটাই নিয়তের স্থলাভিষিক্ত। এজন্যে যে রোজার জন্যই সেহরি খাওয়া হয়। অবশ্যই যারা ঐ সময় খেতে সাধারণত অভ্যস্ত অথবা যেসব নাদান নিয়মিত সেহরি খায় কিন্তু রোজা রাখে না, তাদের জন্য নিয়ত করা জরুরী। 

২. রমজানের প্রত্যেক রোজার জন্য আলাদা নিয়ত করা জরুরী। গোটা রমজানের জন্য একবার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়। 

৩. রমজানের চলতি রোজার জন্য ফরজ বলে নিয়ত করা জরুরী নয়। শুধু রোজার নিয়ত করাই যথেষ্ট। কিন্তু কোন রোগী রমজানের রোজা রাখলে সে ফরজের নিয়ত করবে। কারণ তার উপর রমজানের রোজা ফরজ নয়। যদি শুধু রোজার নিয়ত করে অথবা নফল রোজার নিয়ত করে তাহলে তার রোজা রমজানের রোজা হবে না। 

৪. মুসাফিরের জন্য জরুরী যে রমজানে সে যেন অন্য কোন ওয়াজিব রোজার নিয়ত না করে। 

৫. রমজানের কাযা রোজার জন্য নির্দিষ্ট করে ফরজের নিয়ত করা জরুরী। 
৬. রোজায় দুপুরের পূর্বে নিয়ত করলে দুরস্ত (জায়েজ) হবে। 

৭. রাতে রোজা রাখার নিয়ত ছিল না। সকালেও রোজা রাখার খেয়াল ছিল না, তারপর দুপুরের আগে হঠাৎ মনে পড়লো যে, রমজানের রোজা ছাড়া ঠিক নয় এবং তড়িঘড়ি করে নিয়ত করে ফেলল, তাহলে রোজা দুরস্ত (জায়েজ) হবে। কিন্তু সকালে যদি কিছু খেয়ে থাকে তাহলে তো নিয়ত করার কোনো অবকাশই রইলো না।

 ৮. রমযান মাসে কেউ ফরয রোযার পরিবর্তে নফল রোযার নিয়ত করলো এবং মনে করলো যে পরে ফরয রোযার কাযা করে নেবে। তথাপি সে রোযা রমযানের রোযাই হবে। নফল রোযা হবে না। এমনি নফল রোযার পরিবর্তে ওয়াজিব রোযার যদি নিয়ত করে,তথাপি রমযানের রোযা হবে। নীতিগত এক এই যে, রমযানে শুধু রমযানের ফরয রোযাই হবে,অন্য রোযা হবে না। 

৯. রোযা সুবেহ সাদেক থেকে শুরু হয়। অতএব সুবেহ সাদেকের পূর্বে এ সকল কাজ জায়েয যার থেকে বিরত থাকা রোযার মধ্যে ফরয। কেউ মনে করে যে, রোযার নিয়ত করার পর কিছু খাওয়া দাওয়া করা জায়েয নয়। একথা ঠিক নয়। সুবেহ সাদেকের পূর্বে খাওয়া দাওয়া প্রভৃতি জায়েয-যদিও সূর্যাস্তের পরই পরের দিনের রোযার নিয়ত করা হয়ে থাকে। 

১০. কেউ রাতে ইচ্ছা করলো যে, পরদিন রোযা রাখবে। কিন্তু সকাল হওয়ার পূর্বেই ইচ্ছা পরিবর্তন করলো এবং রোযা রাখলো না। এ অবস্থায় কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

 ১১. রাতে নিয়ত করলে বলবে আমি আগামীকাল মাহে রমযানের রোযা রাখার নিয়ত করলাম। দিনে নিয়ত করলে বলবে মাহে রমযানের আজকের দিনের রোযার নিয়ত করছি। কিন্তু আরবীতে নিয়ত করা জরুরী (অত্যাবশ্যক) নয়, যে কোনো ভাষায় বলা যায়।


▪ রোজার আধুনিক মাসায়েল (পর্ব ১)

রােজা অবস্থায় ওষুধের ব্যবহার বিধিমালা” এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ফিকহী মাসায়েলের পক্ষ-বিপক্ষ বিশ্লেষণ।

[কৃতজ্ঞতায়ঃ (ডা. এস এম হানিফ) যার থেকে উক্ত সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের কপিটি সংগ্রহ করা হয়েছে।]
[ব্যাখ্যা সংযুক্তকরণঃ
Masum Billah Sunny,
ব্লগার, সুন্নি-বিশ্বকোষ & Studying MBBS, Southern Medical College & Hospital]

➖➖➖➖➖➖➖
জুন মাসে মরক্কোতে অনুষ্টিত নবম ফিকাহ- চিকিৎসা সম্মেলন (9th Fiqh Medical Seminar, Morocco) থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সম্মেলনেঃ
(১) জেদ্দা ইসলামিক ফিকাহ একাডেমী,
(২) আল-আজহার ইউনিভার্সিটি,
(৩) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আলেকজান্দ্রিয়া, মিসর এবং
(৪) ইসলামিক শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ISESCO- The Islamic Educational, Scientific and Cultural Organization) প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

এই সম্মেলনে মূল আলােচনার বিষয় ছিল- রােজা অবস্থায় যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধ প্রয়ােগে রােজা নষ্ট হবে। বিষয়ে একটা সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়া। এ লক্ষ্যে ইসলামিক চিন্তাবিদরা চিকিৎসা বিজ্ঞানে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলােচনা ও গবেষণা করে
রোজা অবস্থায় ওষুধ প্রয়ােগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে সচিন্তত তথ্য উপস্থাপন করেন, যা ২০০৪ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজে) বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে প্রকাশিত তথ্য নিচে তুলে ধরা হলােঃ

[তথ্যের নিচে পক্ষে-বিপক্ষে উলামায়ের কেরামের ফতোয়া ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে ফিকাহের জ্ঞানকে একত্রে নিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আল্লাহ পাক ভুল-ত্রুটি ক্ষমাকারী ও আমাদের আমলগুলো কবুল করার মালিক___Masum Billah Sunny]

➖➖➖➖➖➖➖➖➖

(১) রােজা অবস্তায় চোখ, নাক ও কানের ড্রপ, স্প্রে ব্যবহার করা যাবে। নাকের ড্রপ ও স্প্রে ব্যবহার করা যাবে তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল এটি যাতে গলার ভিতর বা পেটের ভিতর চলে না যায়। চলে গেলে রােজা ভেঙ্গে যাবে। তবে শুধু মুখের ভেতর আসলে তা না গিলে কুলি করে বাহিরে ফেলে দিলে রােজা নষ্ট হবে না।
[অনেক উলামায়ে কেরামের মতে "নাকে বা কানে তেল বা ঔষধ প্রবেশ করানো।" হলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। বিশেষ করে নাকের ড্রপ Pharynx হয়ে গলা দিয়ে পাকস্থলিতে নামার সম্ভবনা খুবই বেশি। এমন হলে রোজা অবশ্যই ভঙ্গ হয়ে যাবে। সুতরাং উত্তম হল রোজা অবস্থায় নাকে-কানে তেল বা ওষুধ ব্যবহার না করা।]

(২) চিকিৎসার প্রয়ােজনে রােজা রেখে অক্সিজেন, নেবুলাইজেশন, ইনহেলার কিংবা চেতনানাশক গ্যাস গ্রহণে রােজা নষ্ট হবে না।

[অক্সিজেন (Oxygen): রোজা অবস্থায় ঔষধ ব্যবহৃত অক্সিজেন ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। তবে শুধু বাতাসের অক্সিজেন নিলে রোযা ভাঙ্গবে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

সমাধানঃ যদি তরল জাতীয় স্প্রে হয়, যার ফলে স্প্রে করার পর গলা অতিক্রম করে পাকস্থলীতে পৌঁছে যায় তবে রোজা ভঙ্গ হবে। তাছাড়া Oxygen তখনই দরকার পড়ে যখন একজন মানুষ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এমতঅবস্থায় রোগীর নিকট সব অস্বস্তিবোধ হয়। এমনকি শুয়ে থাকতেও কষ্ট হয় বলে ডাক্তারগণ রোগীকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেন। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসে সুবিধা হয়। রোগাক্রান্ত  অবস্থায় রোজা ভঙ্গের অনুমতি রয়েছে।
তাই কোনটা উত্তম? এই প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় রোগে আক্রান্ত হয়ে একদিকে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে ওষুধ নিলে রোজা হবে কিনা সেই আশংকা থেকে সুস্থ হয়ে রোজা কাযা করাই উত্তম। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর হাদিসে যেখানে পাওয়া যায় সফররত অবস্থায়
কষ্ট হলে রোজা ভাঙ্গা যাবে সেখানে Serious কোন রোগ হলেও রোজা ভাঙা যাবে।
কারণ একদিকে যেমন রোজার মূল্য অপরিসীম তেমনি জরুরি প্রয়োজনে কিংবা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উপনিত হলে রোজা ভঙ্গ করে কাযা করার ক্ষেত্রে কোন মতানৈক্য নেই।]

(৩) হার্টের এনজাইনার সমস্যার জন্য হঠাৎ বুকে ব্যথা উঠলে ব্যবহৃত নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট বা স্প্রে জিহ্বার নিচে ব্যবহার করলে রােজা নষ্ট হবে না। তবে খেয়াল রাখতে হবে ওষুধ যেন গিলে ফেলা না হয়। গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে।

[নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitro Glycerin): এরোসল জাতীয় ওষুধ, যা হার্টের জন্য দুই-তিন ফোটা জিহ্বার নীচে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখে।ওষুধ শিরার মাধ্যমে রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ওষুধের কিছু অংশ গলায় প্রবেশ করার প্রবল সম্ভবনা রয়েছে। [গলায় প্রবেশ করলে, আর গিলে ফেললে] এতে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

সমাধানঃ জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রোজা না রেখে কাজা করার বিধান রয়েছে। সুতরাং এমতবস্থায় রোজা ভঙ্গ করে চিকিৎসা করা উচিত, পরবর্তীতে ইহা কাযা করতে হবে।]

(৪) হার্ট বা অন্য কোনাে অঙ্গের এনজিওগ্রাম করার জন্য কোনাে রােগ নির্ণায়ক দ্রবণ শরীরে প্রবেশ করানাে হলে তাতেও রােজার কোনাে ক্ষতি হবে না।

[এনজিওগ্রাম (Angio Gram):
"হার্ট ব্লক হয়ে গেলে উরুর গোড়া দিয়ে কেটে বিশেষ রগের ভিতর দিয়ে হার্ট পর্যন্ত যে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয় তার নাম এনজিওগ্রাম। এ যন্ত্রটিতে যদি কোন ধরনের ঔষধ লাগানো থাকে তারপরেও রোজা ভাঙ্গবে না। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা)]

(৫) রােগ নির্ণয়ে এন্ডােস্কোপি (I), গ্যাস্ট্রোস্কোপি (II) বা সিস্টোস্কপি (III) করলেও রােজা নষ্ট হয় না। তবে এন্ডােস্কোপি বা গ্যাস্ট্রোস্কোপি করার সময় ভিতরে তরল, ওষুধ কিংবা অন্য কোনাে কিছু প্রবেশ করানাে যাবে না, এতে করে পাকস্থলিতে পৌঁছালে রোজা ভেঙে যাবে।

["(I) এন্ডোস্কোপি (Endoscopy): চিকন একটি পাইপ যার মাথায় বাল্ব জাতীয় একটি বস্তু থাকে। পাইপটি পাকস্থলিতে ঢুকানো হয় এবং বাইরে থাকা মনিটরের মাধ্যমে রোগীর পেটের অবস্থা নির্নয় করা হয়। এ নলে যদি কোন ঔষধ ব্যবহার করা হয় বা পাইপের ভিতর দিয়ে পানি/ঔষধ ছিটানো হয়ে থাকে তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে, আর যদি কোন ঔষধ লাগানো না থাকে তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

(II) লেপারোস্কোপি (Laparoscopy):
শিক্ জাতীয় একটি যন্ত্র দ্বারা পেট ছিদ্র করে পেটের ভিতরের কোন অংশ বা গোশত ইত্যাদি পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বের করে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র। এতে যদি ঔষধ লাগানো থাকে তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে অন্যস্থায় রোযা ভাঙ্গবে না। (আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)

(III) সিস্টোসকপি (Cystoscopy):
প্রসাবের রাস্তা দিয়ে ক্যাথেটার প্রবেশ করিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় এর দ্বারা রোজা ভাঙ্গবে না। (হেদায়ার হাশিয়া)

(IV) প্রক্টোসকপি (Proctoscopy):
পাইলস, পিসার, অর্শ, হারিশ, বুটি ও ফিস্টুলা ইত্যাদি রোগের পরীক্ষাকে প্রক্টোস্কোপি বলা হয়। মলদ্বার দিয়ে নল প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। রোগী যাতে ব্যথা না পায় সে জন্য নলের মধ্যে গ্লিসারিন জাতীয় কোন পিচ্ছল বস্তু ব্যবহার করা হয়। নলটি পুরোপুরী ভিতরে প্রবেশ করে না। চিকিৎসকদের মতানুসারে ঐ পিচ্ছিল বস্তুটি নলের সাথে মিশে থাকে এবং নলের সাথেই বেরিয়ে আসে, ভেতরে থাকে না। আর থাকলেও তা পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে। যদিও শরীর তা শোষণ করে না কিন্তু ঐ বস্তুটি ভিজা হওয়ায় {GIT (Gastro intestinal Tract) এ প্রবেশ করার কারণে} রোজা ভেঙ্গে যাবে। (ফতওয়া শামীর হাশিয়া)]

(৬) রােজা রাখা অবস্থায় লিভারসহ অন্য যে কোনাে অঙ্গের বায়ােপসি করা যাবে।

(৭) রােজা রাখা অবস্থায় পেরিটোনিয়াল কিংবা মেশিনে কিডনি ডায়ালাইসিস (Dialysis) করা যাবে।

(৮) শিরাপথে খাদ্য উপাদান ছাড়া কোনাে ওষুধ ত্বক, মাংসপেশি কিংবা হাড়ের জোড়ায় ইনজেকশন হিসেবে প্রয়ােগ করলে রােজার
কোনাে ক্ষতি হবে না। (I)
তবে রােজা রাখা অবস্থায় স্যালাইন বা গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক কিছু জাতীয় কোনাে তরল শিরাপথে গ্রহণ করা যাবে না। এতে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। (II)

[(I) যেমনঃ ইনসুলিন। যা subcutaneous Route এ চামড়ার নিচে নেয়া হয়।
"ইনসুলিন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, ইনসুলিন রোযা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য খালী জায়গায় প্রবেশ করে না।" (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)

পরামর্শঃ এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। উত্তম হল সাহরির সময় ইনসুলিন নিয়ে নেয়া। এতে সারাদিন আর নেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। কারণ মূল্যবান এই রোজা ভঙ্গ হওয়ার আশংকা মনের মধ্যে সব সময় কাজ করে।
(II) সবাই একমত]

(৯) চিকিৎসার প্রয়ােজনে যা চর্ম দ্বারা শরীরে শােষিত হয় এমন সকল ঔষধ, যেমন- ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট, ব্যান্ডেজ, মেডিকেটেড প্লাস্টার ইত্যাদি ব্যবহার করলে রােজার কোনাে সমস্যা হবে না।

[কারণ এগুলো Locally কাজ করে অর্থাৎ, শুধুমাত্র ঐ জায়গাতেই কাজ করে অথবা তেলের মত ত্বকের নিচ পর্যন্ত পৌঁছায়। আর তেল লোমকূপ দিয়ে প্রবেশ করলে অথবা গোসলের সময় পানি লোমকূপ দিয়ে ভিতরে ঢুকলেও রোজা ভঙ্গ হয় না]

(১০) রােজা রেখে জরুরি ভিত্তিতে দাঁত তােলা যাবে এবং দাঁতের ফিলিং করা যাবে এবং ড্রিল ব্যবহার করা যাবে। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন রক্ত, পানি বা মেডিসিন যাতে গিলে না ফেলা হয়। এতে রোজা ভেঙে যাবে।
[ভেঙে গেলে কাযা আদায় করতে হবে।]

(১১) পেস্ট কিংবা মাউথওয়াশ (গার্গল/প্রে) ব্যবহার করলে রােজা ভাঙবে না। খেয়াল রাখতে হবে যেন গিলে ফেলা না হয়। এতে রোজা ভেঙে যাবে। সবচেয়ে উত্তম হল এগুলাে ব্যবহার না করে মেসওয়াক ব্যবহার করা।
[তবে উলামায়ে কেরামের মতে সর্বদা মিসওয়াক ব্যবহার সুন্নত আর রোজা অবস্থায় পেষ্ট কিংবা অন্যান্য মাজন ব্যবহারে রোজা মাকরুহ হবে]

(১২) রােজা রেখে রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত দিলে এবং কাউকে রক্ত দানেও কোনাে বাধা নেই। সুস্থ সবল ব্যক্তির রক্ত দান করলে রােজা ভঙ্গ হয় না। (I) কিন্তু রক্ত গ্রহণ করলে রােজা ভাঙবে। (II) রক্তদানের পর রক্তাদাতা দুর্বল অনুভব করলে রােজা ভেঙ্গে ফেলতে পারেন। এ জন্য কাফফারা দিতে হবে না, পরে শুধু একটি রােজা কাজা করলেই হবে।

[রক্ত দেয়া বা নেয়াঃ
রোজা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের করলে  রোজা ভাঙ্গবে না। (আহসানুল ফতওয়া)

(I) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রোজা রাখা অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়ে রক্ত বের করেছেন যা অসংখ্য সহিহ হাদিসে রয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় রক্ত বের হলে রোজা ভঙ্গ হয় না।

(II) অন্যদিকে রোজা অবস্থায় কোন ব্যক্তি যদি রক্ত গ্রহণ করে তবে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে কারণ Blood এ আমাদের যাবতীয় পুষ্টি, খাদ্য-শক্তিবর্ধক উপাদান থাকে যা Donor থেকে (Recipient) গ্রহীতার রক্তে চলে যাবে। কাউকে খাওয়ানোর জন্য মুখে খাবার দেওয়াই জরুরি নয় Intra venous route এ অথবা Nasogastric tube দিয়েও খাওয়ানো যায়। হাসপাতালে থাকা অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য এভাবেই দিনের পর দিন খাবারের চাহিদা মিটানো হয়।]

(১৪) পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যােনিপথ কিংবা পায়ুপথে চিকিৎসক বা ধাত্রী আঙ্গুল প্রবেশ করালেও রােজা নষ্ট হবে না। এছাড়া রােজা রেখে জরায়ু পরীক্ষার জন্য হিস্টোরােস্কোপি এবং আইইউসিডি প্রতিস্থাপন ও ব্যবহার করা যাবে।

[এটি একটি চিকিৎসা প্রক্রিয়া। যেমনঃ Per Rectal Examination (যাতে পায়ুপথে আঙ্গুল প্রবেশ করানো হয়) & Per Vaginal Examination (যাতে যোনিপথে আঙ্গুল প্রবেশ করানো হয়)
এই পরীক্ষার মাধ্যমে Surgery কিংবা Gynecologist ডাক্তারগণ কতিপয় রোগ সম্পর্কে ধারণা নেন অথবা শনাক্ত করেন। যা রোজা ভঙ্গের কারণের মধ্যে পরে না।]

(১৫) জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া ও সার্জারির জন্য রােজা ভঙ্গ হয়। মেজর সার্জারির জন্য রােজা না রেখে রমজান শেষে যেকোনাে সময় এটি কাজা আদায় করে নিতে হবে। এটাই উত্তম। এই জন্য তাকে কাফফারা (একটানা ৬০টি) রােজা দিতে হবে না।

[পরামর্শঃ অপারেশন এর পর এমনিতেই রক্তের একটা ঘাটতি থাকে এমতবস্থায় রোজা রাখলে শারীরিকভাবে ঐ ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। এরকম Serious অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করে কাযা করাই শ্রেয়।]

(১৬) অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রােজা ভঙ্গ হবে না। তবে ইচ্ছা করে বমি করলে রােজা ভেঙ্গে যাবে।

(১৭) নাক (এর বাহির) দিয়ে রক্ত পড়লে রােজা নষ্ট হবে না।
[তবে নাকের ভিতর দিয়ে রক্ত যদি Nasopharynx ➡ Oropharynx হয়ে গড়িয়ে➡ খাদ্যনালী (Esophagus) দিয়ে➡ পাকস্থলীতে পৌঁছায়। তখন রোজা ভঙ্গ হবে। এমতবস্থায় কাযা করতে হবে।]

(১৮) গর্ভবতী কিংবা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায় এমন মা যদি রােজার কারণে তার নিজের কিংবা সন্তানের ক্ষতির আশংঙ্কা যদি করেন, দুর্বলতা বােধ করে অথবা দুধ শুকিয়ে যায় (বা বাচ্চা দুধ কম পায়), তার জন্য রােজা রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে যে রােজাগুলাে বাদ যাবে, পরবর্তীতে যখন তার জন্য সহজ হবে এবং বাচ্চার ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না। তখন বাদ যাওয়া রােজাগুলাে শুধু কাজা আদায় করে নিলেই হবে। এর জন্য কাফফারা দিতে হবে না।


▪  রোজার  আধুনিক মাসায়েল (পর্ব ২)

রোজা অবস্থায় আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ক মাসায়েল (পর্ব ২)

📌 কনডম (Condom), কপার-টি (Coper-T) or Other Contraceptive Method (জন্মনিরোধক ডিভাইস) :
কপার-টি একটি Contraceptive Method. যার মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতে যোনিদ্বারে প্লাস্টিক সহ কপারের পাত সংযুক্ত থাকে। যা Spermicidal (শুক্রানুকে মেরে ফেলতে) সহায়তা করে, যেন সহবাসের সময় বীর্যপাত হলে বীর্য জরায়ুতে পৌঁছাতে না পারে। রোজা অবস্থায় যদি (কনডম/কপার-টি) লাগিয়েও সহবাস করা হয় তবুও রোযা ভেঙ্গে যাবে। বীর্যপাত হোক না হোক যোনিদ্বারে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করালেই রোজা ভেঙ্গে যাবে। কাযা ও কাফফারা উভয়টাই ওয়াজিব হবে।

📌 সিরোদকার অপারেশন (Shirodkar Operation):
সিরোদকার অপারেশন হল অকাল গর্ভপাত হওয়ার আশংখা থাকলে জরায়ুর মুখের চতুষ্পার্শ্বে সেলাই করে মুখকে খিচিয়ে রাখা।এতে অকাল গর্ভপাত রোধ হয়।যেহেতু এতে কোন ঔষধ বা বস্তু রোযা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য খালি স্থানে পৌছে না তাই এর দ্বারা রোযা ভাঙ্গবে না।

📌 ডি এন্ড সি (Dilatation and Curettage):
ডি এন্ড সি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে আট থেকে দশ সপ্তাহের মধ্য Dilator এর মাধ্যমে জীবত কিংবা মৃত বাচ্চাকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়। যাকে বলা হয় miscarriage or abortion. এতে রোযা ভেঙ্গে যাবে। অযথা এমন করলে কাযা কাফফারা উভয়টি দিতে হবে এবং তওবা করতে হবে। (হেদায়ার হাশিয়া)

📌 এম আর (M.R):
এম আর (Menstrual Regulation) হল গর্ভধারণের ফলে যখন ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায় তখন ঋতুস্রাব পুরনায় চালু করার একটি প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে পাঁচ থেকে আঁট সপ্তাহের মধ্যে যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ুতে এম,আর সিরিন্জ (MR Syringe) প্রবেশ করিয়ে জীবিত অথবা মৃত ভ্রণকে নিয়ে আসা। যার ফলে ঋতুস্রাব পুনরায় চালু হয়। অতএব মাসিক শুরু হওয়ার কারণে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।

📌 আলট্রাসনোগ্রাম (Ultrasongram): আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় যে ঔষধ বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সবই চামড়ার উপরে থাকে, তাই আলট্রাসনোগ্রাম করলে রোযা ভাঙ্গবে না। (হেদায়ার হাশিয়া)

📌 স্যালাইন (Saline):
স্যালাইন নেয়া হয় রগে। এটা দুর্বল ও অসুস্থ ব্যক্তিকে শক্তি যোগানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
জীবানুমুক্ত প্রতি লিটার দ্রাবকে ৯ গ্রাম লবণ যুক্ত করাকে নরমাল স্যালাইন বলা হয়। এটা গ্রহণ করলে সন্দেহব্যতীত রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কারণ রক্তে খাদ্য উপাদান সাপ্লাই করা হলে রোজা ভেঙ্গে যায়।
তাছাড়া ডায়রিয়া-আমাশয়-কলেরা রোগী স্যালাইন গ্রহণ করলে সন্দেহব্যতীত রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।

📌 ঢুস লাগানো (Douche) :
[ঢুস / Suppository মলদ্বারের মাধ্যমে দেহের ভিতরে GIT তে প্রবেশ করে। পাকস্থলি যেমন GIT এর অন্তর্ভুক্ত তেমনি মলদ্বার (Rectum, Anal Canal ও GIT এর অংশ) যার মাধ্যমে ওষুধ রক্তে Absorb হয়।] তাই ঢুস নিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। ঢুস যে জায়গা বা রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে এ জায়গা বা রাস্তা রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য স্থান। (ফতওয়া শামীর হাশিয়া)

📌 মস্তিষ্ক অপারেশন (Brain Operation): রোজা অবস্থায় মস্তিস্ক অপারেশন করে ঔষধ ব্যবহার করা হোক বা না হোক রোজা ভাঙ্গবে না। (আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)

📌 ইনসুলিন গ্রহণ করা (Insulin) :
ইনসুলিন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, ইনসুলিন রোযা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য খালী জায়গায় প্রবেশ করে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
[তবে এতে হবে কি হবে না এ বিষয়ে মতানৈক্য আছে তাই না নেয়াই উত্তম, নিলে ভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে]

📌 মানসিক রােগীর রােযাঃ
মানসিক রােগীর রােযা রাখার কারণে অসুস্থতা বৃদ্ধির প্রবল আশঙ্কা থাকলে রােযা ভাঙার অনুমতি আছে, তবে সুস্থ হওয়ার পরে কাযা আদায় করে নিতে হবে অন্যথায় ফিদ্ইয়া আদায় করতে হবে।
[ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম, খ ৬, পৃ. ৪৮৭]

📌 প্রােস্টেট গ্লান্ডের রোগে আক্রান্ত রােগীর রােযাঃ
যদি রােগীর অবস্থা এমন হয় যে, তার প্রােস্টেট গ্লান্ডের অসুস্থতায় ক্যাথেটার লাগানাে হয়েছে অথবা ডাক্তার প্রস্রাবের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে ভিন্ন পথে নলের মাধ্যমে প্রস্রাবের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, এতে ইউরিন বক্সে আপনা আপনি প্রস্রাব ঝরছে; এমতাবস্থায় রােগী সক্ষম থাকলে রােযা চালিয়ে যাবে। তার এ ধরনের অসুস্থতায় রােযা নষ্ট হবে না। কেননা এ ধরনের রােগীর পেটের ভেতরে যাওয়ার মত কিছুই নেই। পাকস্থলী নিরাপদ থাকে বিধায় রােযা ভাঙার কোনাে সুযােগ নেই।
[পবিত্র মাহে রমজান ও সিয়াম সাধনা, পৃ ২৩৩]

📌 অপারেশনের রােগীর রােযাঃ
মেজর কোন অপারেশন হলে রােযা রাখা জায়িয নেই। কিন্তু সাধারণ অপারেশন যেমনঃ হাত অথবা পায়ের টিউমার অপারেশন
ভাঙ্গা-মচকা, পায়ে ছােটখাটো অপারেশন, হাত-পায়ের কোনাে ক্ষতস্থানের অপারেশনে রােযা ভঙ্গ হয় না।
মুখের ভিতরের দাঁতের অপারেশন,  নাক-কানের অভ্যন্তরে অপারেশন অথবা প্রস্রাব ও বাহ্য ইন্দ্রিয়ের অভ্যন্তরে অপারেশন করে কোনাে অংশ কেটে ফেলে দিলে রোযা নষ্ট হবে না। তবে ওষুধ প্রবেশ করানাে হলে ওষুধের অংশ মস্তিষ্কে বা পাকস্থলীতে প্রবেশ করলে রােযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। পাকস্থলীর অপারেশনের সময় পেটের কোনাে অংশ বের করলে এবং পুনরায় সংযােজন করলে রােযা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
[আহসানুল ফাতাওয়া; জাদীদ ফিকহী মাসাইল।]

📌 মাথায় বা পেটে আঘাতপ্রাপ্ত রােগীর রােযাঃ
মাথার কোনাে ঘায়ের অপারেশন হলে অথবা আঘাতে মাথা ফেটে গেলে ক্ষতস্থানে ডাক্তার অপারেশন করলে রােযা নষ্ট হবে না। মাথার উপরিভাগের ক্ষত যদি মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে আর পেটের ক্ষত যদি পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং ওষুধও পাকস্থলীতে পৌঁছে তাহলে রােযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এ ছাড়া শরীরে অন্য কোন স্থানের জখমে ওষুধ ব্যবহার করলে তাতে রােযা ভঙ্গ হবে না।
[পবিত্র মাহে রমজান ও সিয়াম সাধনা, পৃ ২৩৫]

📌 চক্ষু অপারেশন রােগীর রােযাঃ
চোখের সাথে পাকস্থলীর কোনাে যােগাযােগ পথ নেই। তবে নাক-কান-গলা তিনটি পাশাপাশি থাকার কারণে কখনাে গলার মাসআলা চোখ এর ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা হয়।  চক্ষু অপারেশন হলে, চোখে ড্রপ, সুরমা বা মলম দিলে রােযা ভঙ্গ হয় না। যদি গলায় কোনাে স্বাদ পাওয়া যায় তাহলে থুতুর সাথে বাইরে ফেলে দিলেই চলবে। [অন্যাথায় পেটে প্রবেশ করলে রোজা ভেঙ্গে যাওয়া সম্ভাবনা রয়েছে]
[পবিত্র মাহে রমজান ও সিয়াম সাধনা, পৃ ২৩৫]


▪ যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না


যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় নাঃ 

১) ভুলবশতঃ আহার করলে, পান করলে কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে রোযা ভাঙ্গে না, চাই ওই রোযা ফরয হোক কিংবা নফল।
(আদ-দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
★হযরত সায়্যিদুনা আবু হুরায়রা ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ থেকে বর্ণিত, তাজেদারে মদীনা হযরত মুহাম্মদ ﷺ ইরশাদ করেন, “যে রোযাদার ভুলবশতঃ পানাহার করেছে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ, তাকে আল্লাহ তাআলা পানাহার করিয়েছে।
(সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬৩৬, হাদীস নং-১৯৩৩)

২) কোন রোযাদারকে এসব কাজে করতে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। যদি আপনি স্মরণ করিয়ে না দেন তবে গুনাহগার হবেন। হাঁ, যদি রোযাদার খুবই দুর্বল হয়, কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিলে পানাহার ছেড়ে দেবে, যার ফলে তার দূর্বলতা এতোই বেড়ে যাবে যে, তার জন্য রোযা রাখা কঠিন হয়ে যাবে, আর পানাহার করে নিলে রোযাও ভালোমতে পূর্ণ করে নেবে এবং অন্যান্য ইবাদতও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, (যেহেতু সে ভুলে পানাহার করছে, এ কারণে তার রোযাও পূর্ণ হয়ে যাবে।)
এমতাবস্থায়, স্মরণ করিয়ে না দেয়াই উত্তম। কোন কোন মাশাইখ কিরাম ﺭَﺣْﻤَﺔُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ বলেন, “যুবককে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেবেন, আর বৃদ্ধকে দেখলে স্মরণ করিয়ে না দিলেও ক্ষতি নেই।” কারণ, যুবক বেশিরভাগই শক্তিশালী হয়ে থাকে। আর বুড়ো হয় বেশিরভাগ দুর্বল। সুতরাং বিধান হচ্ছে এ যে, যৌবন ও বার্ধক্যের কোন কথা এখানে নেই, বরং সক্ষম হওয়া ও দুর্বলতাই এখানে বিবেচ্য। অতএব যুবকও যদি এ পরিমাণ দূর্বল হয়,তবে স্মরণ করিয়ে না দেয়ার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই। আর বয়স্ক অথচ যদি শক্তিশালী হয় তবে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব।
(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)

৩) রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও যদি মাছি কিংবা ধুলিবালি কিংবা ধোঁয়া কণ্ঠনালী দিয়ে ভিতরে চলে যায়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হয় না, চাই ধুলি আটার হোক, যা চাক্কি পেষণ কিংবা আটা মেশিনে নেয়ার সময় উড়ে থাকে, চাই ফসলের ধুলি হোক, চাই বাতাসে মাটি উড়ে আসুক, কিংবা পশুর খুর ও পা থেকে আসুক।
(আদ দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৬৬)

৪) অনুরূপভাবে, বাস কিংবা গাড়ির ধোঁয়া অথবা সেগুলোর কারণে ধুলি ওড়ে কণ্ঠনালীতে পৌঁছে, যদিও রোযাদার হবার কথা স্মরণ ছিলো, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না।

৫) যদি এমন হয় যে, বাতি জ্বলছে, আর সেটার ধোঁয়া নাকে প্রবেশ করেছে, তবু রোযা ভাঙ্গবে না। হাঁ, যদি লোবান কিংবা আগর বাতি জ্বলতে থাকে আর রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও মুখ সেটার নিকটে নিয়ে গিয়ে নাক দ্বারা ধোঁয়া টানে, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
(রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৬)

৬) শিঙ্গা লাগালো (*) কিংবা তেল অথবা সুরমা লাগালো, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না; যদিও তেল কিংবা সুরমার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভুত হয়, এমনকি যদি থুথুুর মধ্যে সুরমার রঙও দেখা যায়, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না।
(আল-জাওহারাতুন্ নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৯)

* এটা ব্যথার চিকিৎসার একটা বিশেষ পদ্ধতি, যাতে ছিদ্র শিং ব্যথাগ্রস্ত স্থানে রেখে মুখ দিয়ে শরীরের দুষিত রক্ত টেনে বের করা হয়।

৭) গোসল করলে পানির শীতলতা, ঠান্ডা ভিতরে অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২৩০)

৮) কুলি করে পানি ফেলে দিলো। শুধু কিছুটা আর্দ্রতা মুখে অবশিষ্ট রয়ে গেলো, থুথুুর সাথে তা গিলে ফেলল, রোযা ভাঙ্গবে না।
(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)

৯) ঔষধ দাঁতে কাটলো, কণ্ঠনালীতে সেটার স্বাদ অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)

১০)  কানে পানি ঢুকে গেলে, রোযা ভঙ্গ হয় না, বরং খোদ্ পানি ঢাললেও রোযা ভাঙ্গবে না।
(আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)

১১) খড়কুটা দ্বারা কান চুলকালো, ফলে ওই খড়কুটার ময়লা লেগে গেলো, আর ওই খড়কুটাটি পুনরায় কানে দিলো। সে কয়েকবার এমন করলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
(আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)

১২) দাঁত কিংবা মুখে হালকা এমন কোন জিনিষ অজানাবশতঃ রয়ে গেলো, যা থুথুর সাথে নিজে নিজেই নিচে নেমে যায়। বাস্তবেও তা নেমে গেছে। তবুও রোযা ভাঙ্গবে না।
(আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)

১৩) দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে কণ্ঠনালী পর্যন্ত গেলে, কিন্তু কণ্ঠনালী অতিক্রম করে নিচে নামেনি। এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গেনি।
(ফতহুল কদীর, খন্ড-২য়, পৃ-২৫৭)

১৪) মাছি কণ্ঠনালীতে চলে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)

১৫) ভুল করে খাবার খাচ্ছিলো। মনে হতেই লোকমা ফেলে দিলে কিংবা পানি পান করছিলো, স্মরণ হতেই মুখের পানি ফেলে দিলো। তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি মুখের ভিতরের লোকমা কিংবা পানি স্মরণ হওয়া সত্ত্বেও গিলে ফেলে
তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)

১৬) সুবহে সাদিকের পূর্বে আহার কিংবা পান করছিলো, আর ভোর হতেই (অর্থাৎ সাহারীর সময়সীমা শেষ হতেই) মুখের ভিতরের সবকিছু ফেলে দিল, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না, আর যদি গিলে ফেলে তবে ভেঙ্গে যাবে।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)

১৭) গীবত করলে রোযা ভাঙ্গবে না।
(আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬২)
যদিও গীবত জঘন্য কবীরা গুনাহ্। ★কুরআন মজীদে গীবত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতোই।’ আর হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, ‘গীবত যেনা থেকেও জঘন্যতর।’
(আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩১, হাদীস নং-২৬)
অবশ্য, গীবতের কারণে রোযার নূরানিয়্যাত শেষ হয়ে যায়।
(বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-৬১১)

১৮) ‘জানাবত’ (অর্থাৎ গোসল ফরয হবার) অবস্থায় কারো ভোর হলো, বরং গোটা দিনই ‘জুনুব’ (অর্থাৎ গোসল বিহীন) রয়ে গেলো, তবুও রোযা ভাঙ্গেনি।
(আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭২)
কিন্তু এত দীর্ঘক্ষণ যাবত ইচ্ছাকৃতভাবে(অর্থাৎ জেনে বুঝে) গোসল না করা, যাতে নামায কাযা হয়ে যায়, গুনাহ ও হারাম।
★হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ঘরে ‘জুনুবী’ থাকে সে ঘরে রহমতের ফিরিশতা আসে না।”
(বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৬)

১৯) সরিষা কিংবা সরিষার সমান কোন জিনিষ চিবালে, আর থুথুর সাথে কণ্ঠনালী দিয়ে নিচে নেমে গেলে, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি সেটার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভূত হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
(ফতহুল কাদীর, খন্ড-২য়, পৃ- ২৫৯)

২০) থুথুু কিংবা কফ মুখে আসলে সেটা গিলে ফেললো, রোযা ভাঙ্গবে না।
(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)

২১) অনুরূপভাবে নাকে শ্লেষ্মা জমা হয়ে রইলো। তা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে টেনে গিলে ফেললেও রোযা ভাঙ্গবে না।
(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)

২২) রোযা অবস্থায় যদি নিজে নিজে কয়েকবার বমি এসে যায়। (চাই বালতি ভরে হোক)- এর কারণে রোযা ভাঙ্গে না।
(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)

২৩) যদি রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় (জেনে বুঝে) বমি করলো, আর যদি তা মুখ ভর্তি করে আসে, (মুখ ভর্তির সংজ্ঞা সামনে আসছে), তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)

২৪) ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভর্তি বমি হওয়ার ক্ষেত্রে ঐ সময় রোযা ভেঙ্গে যাবে যখন বমির সাথে খানা অথবা পানি বা হলুদ ধরনের তিক্ত ঝাঁঝালো পানি অথবা রক্ত আসে।

২৫) যদি বমিতে শুধু কফ বের হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না।
(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৪)

২৬) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলো; কিন্তু সামান্য বমি আসলো, মুখ ভর্তি হয়ে আসেনি, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না।
(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)

২৭) মুখভর্তি অপেক্ষা কম বমি হলে মুখ থেকে ফিরে গেলো। কিংবা নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায়ও রোযা ভাঙ্গবে না।
(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)

২৮) বিনা ইচ্ছায় মুখভর্তি বমি হয়ে গেলো রোযা ভাঙ্গবে না। অবশ্য, যদি তা থেকে একটা বুটের সমানও গিলে ফেলা হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এক বুটের পরিমাণের চেয়ে কম হলে রোযা ভাঙ্গবে না।
(দুররে মুখতার, খন্ড-২য়, পৃ-৩৯২)

২৯) মুখভর্তি বমির অর্থ হচ্ছে- সেটা অনায়াসে চলে আসে, যা চেপে রাখা যায় না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)



▪ রোযার ভঙ্গের কারণ, রোযার মাকরূহ ও রোযা না রাখার ওযর সমূহ


রোযা ভঙ্গকারী ১৪ টি কারণ

১. পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যায়; যদি রোযাদার হবার কথা স্মরণ থাকে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
২. হুক্কা, সিগারেট, চুরুট ইত্যাদি পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যায়, যদিও নিজের ধারণায় কণ্ঠনালী পর্যন্ত ধোঁয়া পৌছেনি। (বাহারে শরীআত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৭)

৩. পান কিংবা নিছক তামাক খেলেও রোযা ভেঙ্গে যায়। যদিও আপনি সেটার পিক বারংবার ফেলে দিয়ে থাকেন। কারণ, কণ্ঠনালীতে সেগুলোর হালকা অংশ অবশ্যই পৌছে থাকে। (বাহারে শরীআত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৭)
৪. চিনি ইত্যাদি, এমন জিনিষ, যা মুখে রাখলে গলে যায়, মুখে রাখলো আর থুুথু  গিলে ফেললো এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে গেল। (বাহারে শরীআত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৭)
৫. দাঁতগুলোর মধ্যভাগে কোন জিনিষ ছোলা বুটের সমান কিংবা তদপেক্ষা বেশি ছিল। তা খেয়ে ফেললো। কিংবা কম ছিলো; কিন্তু মুখ থেকে বের করে পুনরায় খেয়ে ফেললো। এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে যাবে।(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৪)
৬. দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে তা কণ্ঠনালীর নিচে নেমে গেলো। আর রক্ত থুুথু অপেক্ষা বেশি কিংবা সমান অথবা কম ছিলো, কিন্তু সেটার স্বাদ কণ্ঠে অনুভুত হলো। এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং যদি কম ছিলো আর স্বাদও কণ্ঠে
অনুভুত হয়নি, তাহলে এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৮)
৭. রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও ‘ঢুস’ (*) নিলো, কিংবা নাকের ছিদ্র দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করালো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)
(*) অর্থাৎ কোন ঔষধের ফিতা কিংবা সিরিঞ্জ পায়খানার রাস্তায় প্রবেশ করালো, আর তা সেখানে স্থায়ীও হলো।
৮. কুল্লী করছিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানি কণ্ঠনালী বেয়ে নিচে নেমে গেলো। কিংবা নাকে পানি দিলো; কিন্তু তা মগজে পৌঁছে গেলো। তাহলে রোযা ভেঙ্গে  যাবে। কিন্তু ‍যদি রোযাদার হবার কথা ভুলে গিয়ে থাকে, তবে রোযা ভাঙ্গবে না। যদিও তা ইচ্ছাকৃত হয়। অনুরূপভাবে রোযাদারের দিকে কেউ কোন কিছু নিক্ষেপ করলো, আর তা তার কণ্ঠে পৌঁছে গেলো। তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আল জাওয়াতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৮)
৯. ঘুমন্ত অবস্থায় পানি পান করলে, কিছু খেয়ে ফেললো, অথবা মুখ খোলা ছিলো; পানির ফোঁটা কিংবা বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টি কণ্ঠে চলে গেলো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আল-জাওহারাতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৮)
১০. অন্য কারো থুুথু গিলে ফেললো। কিংবা নিজেরই থুু হাতে নেয়ার পর গিলে ফেললো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আমলগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১১. যতক্ষণ পর্যন্ত থুুথু কিংবা কফ মুখের ভিতর মওজুদ থাকে। তা গিলে ফেললে রোযা ভঙ্গ হয় না। বারংবার থুু থু ফেলতে থাকা জরুরী নয়।
১২. মুখে রঙ্গিন সুতা ইত্যাদি রাখার ফলে থুুথু রঙ্গিন হয়ে গেলো। তারপর ওই রঙ্গিন থুথুু গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৩. চোখের পানি মুখের ভিতর চলে গেলে আর সেটা গিলে ফেললেন। যদি এক/দুই ফোটা হয় তবে রোযা ভাঙ্গবে না। আর যদি বেশি হয়। যারফলে সেটার লবণাক্ততা মুখে অনুভুত হয়। তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। ঘামেরও একই বিধান।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৪. মলদ্বার বের হয়ে গেলো। এমতাবস্থায় বিধান হচ্ছে, তখন খুব ভাল করে কোন কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তা মুছে ফেলার পর দাঁড়াবে যাতে সিক্ততা বাকী না থাকে। আর যদি কিছু পানি অবশিষ্ট ছিলো, আর দাঁড়িয়ে গেলো, যার কারণে পানি ভিতরে চলে গেলো, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। এ কারণে সম্মানিত ফকীহগণ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِمْ বলেন, “রোযাদার পানি ব্যবহারে সময় নিবে না।’ (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)

রোযা পালনকালে বমি হলে!

কখনো যদি রোযার সময় বমি হয়, তখন লোকেরা চিন্তিত হয়ে যায়, আবার কেউ কেউ মনে করে যে, রোযা পালন কালে এমনিতে নিজে নিজে বমি হয়ে গেলেও রোযা ভেঙ্গে যায়। অথচ তেমন নয়। যেমন সায়্যিদুনা আবু হুুরায়রা رضى الله عنه  থেকে বর্ণিত, হুযুর পূরনুর হযরত মুহাম্মদ  ﷺ   এর মহান বাণী, “যার মাহে রমযানে আপনা আপনি বমি এসে যায়, তার রোযা ভাঙ্গে না। আর যে ব্যক্তি জেনে বুঝে, (স্বেচ্ছায়) বমি করে তার রোযা ভেঙ্গে যায়।” (কানযুল উম্মাল, খন্ড-৮ম, পৃ-২৩০, হাদীস নং-২৩৮১৪)  অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, “যার আপনা আপনি বমি এসেছে তার উপর কাযা নেই। আর যে জেনে বুঝে বমি করেছে সে কাযা করবে।” (তিরমিযী, খন্ড-২য়, পৃ-১৭৩, হাদীস নং-৭২০)


বমি সম্পর্কে সাতটা নিয়মাবলী

১. রোযা অবস্থায় যদি নিজে নিজে কয়েকবার বমি এসে যায়। (চাই বালতি ভরে হোক)- এর কারণে রোযা ভাঙ্গে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)
২. যদি রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় (জেনে বুঝে) বমি করলো, আর যদি তা মুখ ভর্তি করে আসে, (মুখ ভর্তির সংজ্ঞা সামনে আসছে), তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভর্তি বমি হওয়ার ক্ষেত্রে ঐ সময় রোযা ভেঙ্গে যাবে যখন বমির সাথে খানা অথবা পানি বা হলুদ ধরনের তিক্ত ঝাঁঝালো পানি অথবা রক্ত আসে।
৪. যদি বমিতে শুধু কফ বের হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৪)
৫. ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলো; কিন্তু সামান্য বমি আসলো, মুখ ভর্তি হয়ে আসেনি, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)
৬. মুখভর্তি অপেক্ষা কম বমি হলে মুখ থেকে ফিরে গেলো। কিংবা নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায়ও রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)
৭. বিনা ইচ্ছায় মুখভর্তি বমি হয়ে গেলো রোযা ভাঙ্গবে না। অবশ্য, যদি তা থেকে একটা বুটের সমানও গিলে ফেলা হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এক বুটের পরিমাণের চেয়ে কম হলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-২য়, পৃ-৩৯২)

মুখভর্তি বমির সংজ্ঞা

মুখভর্তি বমির অর্থ হচ্ছে- সেটা অনায়াসে চলে আসে, যা চেপে রাখা যায় না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)

অযুবস্থায় বমির পাঁচটি শরয়ী বিধান

১. ওযু অবস্থায় (জেনে বুঝে করুক কিংবা নিজে নিজে হয়ে যাক উভয় অবস্থায়) যদি মুখভর্তি বমি আসে, আর তাতে খাদ্য, পানীয় কিংবা হলদে বর্ণের তিক্ত পানি আসে তবে ওযু ভেঙ্গে যাবে। (বাহারে শরীআত, খন্ড-২য়, পৃ-২৬)
২. যদি মুখভর্তি কফ-বমি হয, তবে ওযু ভাঙ্গবে না। (বাহারে শরীআত, খন্ড-২য়, পৃ-২৬)
৩. প্রবাহমান রক্ত বমি হলে ওযু ভেঙ্গে যাবে।
৪. প্রবাহমান রক্তবমি তখনই ওযু ভেঙ্গে ফেলবে, যখন রক্ত থুুথু অপেক্ষা বেশি হয়। (রদ্দে মুহতার, খন্ড-১ম, পৃ-২৬৭) অর্থাৎ রক্তের কারণে বমি লাল হয়ে যায়। তখন রক্ত বেশি বলে গণ্য হবে। এমতাবস্থায় ওযু ভেঙ্গে যায়। আর যদি থুুথু বেশি হয় রক্ত কম হয়, তবে ওযু ভাঙ্গবে না। রক্ত কম হওয়ার চিহ্ন হচ্ছে-পূর্ণ বমি, যাতে থু থু থাকে, তা হলদে বণের্র হবে।
৫. যদি বমিতে জমাট বাঁধা রক্ত বের হয়, আর তা পরিমাণে মুখভর্তি থেকে কম হয়, তবে ওযু ভাঙ্গবে না। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-২য়, পৃ-২৬)

প্রয়োজনীয় হিদায়াত

মুখভর্তি বমি, (কফ ব্যতীত) একেবারে প্রস্রাবের মতোই নাপাক। এর কোন ছিটা কাপড় কিংবা শরীরের উপর না পড়া চাই। এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করুন! আজকাল লোকেরা এ ক্ষেত্রে বড়ই অসতর্কতা দেখায়। কাপড়ে ছিটা পড়ুক তাতে কোন পরোয়াই করে না। আর মুখ ইত্যাদির উপর যেই নাপাক বমি লেগে যায় তাও নির্দ্বিধায় নিজের কাপড় দ্বারা মুছে নেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রত্যেক প্রকারের অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করুন!

ভুলবশতঃ পানাহার করলে রোযা ভাঙ্গে না

হযরত সায়্যিদুনা আবু হুরায়রা  رضى الله عنه  থেকে বর্ণিত, তাজেদারে মদীনা হযরত মুহাম্মদ  ইরশাদ করেন, “যে রোযাদার ভুলবশতঃ পানাহার করেছে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ, তাকে আল্লাহ তাআলা পানাহার করিয়েছে। (সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬৩৬, হাদীস নং-১৯৩৩)

রোযা ভঙ্গ হয় না এমন জিনিসের ব্যাপারে ২১ নিয়মাবলী

১. ভুলবশতঃ আহার করলে, পান করলে কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে রোযা ভাঙ্গে না, চাই ওই রোযা ফরয হোক কিংবা নফল। (আদ-দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
২. কোন রোযাদারকে এসব কাজে করতে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। যদি আপনি স্মরণ করিয়ে না দেন তবে গুনাহগার হবেন। হাঁ, যদি রোযাদার খুবই দুর্বল হয়, কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিলে পানাহার ছেড়ে দেবে, যার ফলে তার দূর্বলতা এতোই বেড়ে যাবে যে, তার জন্য রোযা রাখা কঠিন হয়ে যাবে, আর পানাহার করে নিলে রোযাও ভালোমতে পূর্ণ করে নেবে এবং অন্যান্য ইবাদতও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, (যেহেতু সে ভুলে পানাহার করছে, এ কারণে তার রোযাও পূর্ণ হয়ে যাবে।) এমতাবস্থায়, স্মরণ করিয়ে না দেয়াই উত্তম। কোন কোন মাশাইখ কিরাম رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِمْ বলেন, “যুবককে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেবেন, আর বৃদ্ধকে দেখলে স্মরণ করিয়ে না দিলেও ক্ষতি নেই।” কারণ, যুবক বেশিরভাগই শক্তিশালী হয়ে থাকে। আর বুড়ো হয় বেশিরভাগ দুর্বল। সুতরাং বিধান হচ্ছে এ যে, যৌবন ও বার্ধক্যের কোন কথা এখানে নেই, বরং সক্ষম হওয়া ও দুর্বলতাই এখানে বিবেচ্য। অতএব যুবকও যদি এ পরিমাণ দূর্বল হয়,তবে স্মরণ করিয়ে না দেয়ার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই। আর বয়স্ক অথচ যদি শক্তিশালী হয় তবে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
৩. রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও যদি মাছি কিংবা ধুলিবালি কিংবা ধোঁয়া কণ্ঠনালী দিয়ে ভিতরে চলে যায়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হয় না, চাই ধুলি আটার হোক, যা চাক্কি পেষণ কিংবা আটা মেশিনে নেয়ার সময় উড়ে থাকে, চাই ফসলের ধুলি হোক, চাই বাতাসে মাটি উড়ে আসুক, কিংবা পশুর খুর ও পা থেকে আসুক। (আদ দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৬৬)
৪. অনুরূপভাবে, বাস কিংবা গাড়ির ধোঁয়া অথবা সেগুলোর কারণে ধুলি ওড়ে কণ্ঠনালীতে পৌঁছে, যদিও রোযাদার হবার কথা স্মরণ ছিলো, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না।
৫. যদি এমন হয় যে, বাতি জ্বলছে, আর সেটার ধোঁয়া নাকে প্রবেশ করেছে, তবু রোযা ভাঙ্গবে না। হাঁ, যদি লোবান কিংবা আগর বাতি জ্বলতে থাকে আর রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও মুখ সেটার নিকটে নিয়ে গিয়ে নাক দ্বারা ধোঁয়া টানে, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৬)
৬. শিঙ্গা লাগালো (*) কিংবা তেল অথবা সুরমা লাগালো, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না; যদিও তেল কিংবা সুরমার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভুত হয়, এমনকি যদি থুথুুর মধ্যে সুরমার রঙও দেখা যায়, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না। (আল-জাওহারাতুন্ নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৯)
এটা ব্যথার চিকিৎসার একটা বিশেষ পদ্ধতি, যাতে ছিদ্র শিং ব্যথাগ্রস্ত স্থানে রেখে মুখ দিয়ে শরীরের দুষিত রক্ত টেনে বের করা হয়।
৭. গোসল করলে পানির শীতলতা, ঠান্ডা ভিতরে অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২৩০)
৮. কুলি করে পানি ফেলে দিলো। শুধু কিছুটা আর্দ্রতা মুখে অবশিষ্ট রয়ে গেলো, থুথুুর সাথে তা গিলে ফেলল, রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
৯. ঔষধ দাঁতে কাটলো, কণ্ঠনালীতে সেটার স্বাদ অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১০. কানে পানি ঢুকে গেলে, রোযা ভঙ্গ হয় না, বরং খোদ্ পানি ঢাললেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১১. খড়কুটা দ্বারা কান চুলকালো, ফলে ওই খড়কুটার ময়লা লেগে গেলো, আর ওই খড়কুটাটি পুনরায় কানে দিলো। সে কয়েকবার এমন করলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১২. দাঁত কিংবা মুখে হালকা এমন কোন জিনিষ অজানাবশতঃ রয়ে গেলো, যা থুথুর সাথে নিজে নিজেই নিচে নেমে যায়। বাস্তবেও তা নেমে গেছে। তবুও রোযা  ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১৩. দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে কণ্ঠনালী পর্যন্ত গেলে, কিন্তু কণ্ঠনালী অতিক্রম করে নিচে নামেনি। এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গেনি। (ফতহুল কদীর, খন্ড-২য়, পৃ-২৫৭)
১৪. মাছি কণ্ঠনালীতে চলে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৫. ভুল করে খাবার খাচ্ছিলো। মনে হতেই লোকমা ফেলে দিলে কিংবা পানি পান করছিলো, স্মরণ হতেই মুখের পানি ফেলে দিলো। তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি মুখের ভিতরের লোকমা কিংবা পানি স্মরণ হওয়া সত্ত্বেও গিলে ফেলে
তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৬. সুবহে সাদিকের পূর্বে আহার কিংবা পান করছিলো, আর ভোর হতেই (অর্থাৎ সাহারীর সময়সীমা শেষ হতেই) মুখের ভিতরের সবকিছু ফেলে দিল, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না, আর যদি গিলে ফেলে তবে ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৭. গীবত করলে রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬২)যদিও গীবত জঘন্য কবীরা গুনাহ্। কুরআন মজীদে গীবত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতোই।’ আর হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, ‘গীবত যেনা থেকেও জঘন্যতর।’ (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩১, হাদীস নং-২৬) অবশ্য, গীবতের কারণে রোযার নূরানিয়্যাত শেষ হয়ে যায়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-৬১১)
১৮. ‘জানাবত’ (অর্থাৎ গোসল ফরয হবার) অবস্থায় কারো ভোর হলো, বরং গোটা দিনই ‘জুনুব’ (অর্থাৎ গোসল বিহীন) রয়ে গেলো, তবুও রোযা ভাঙ্গেনি। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭২) কিন্তু এত দীর্ঘক্ষণ যাবত ইচ্ছাকৃতভাবে
(অর্থাৎ জেনে বুঝে) গোসল না করা, যাতে নামায কাযা হয়ে যায়, গুনাহ ও হারাম। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ঘরে ‘জুনুবী’ থাকে সে ঘরে রহমতের ফিরিশতা আসে না।” (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৬)
১৯. সরিষা কিংবা সরিষার সমান কোন জিনিষ চিবালে, আর থুথুর সাথে কণ্ঠনালী দিয়ে নিচে নেমে গেলে, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি সেটার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভূত হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (ফতহুল কাদীর, খন্ড-২য়, পৃ- ২৫৯)
২০. থুথুু কিংবা কফ মুখে আসলে সেটা গিলে ফেললো, রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)
২১. অনুরূপভাবে নাকে শ্লেষ্মা জমা হয়ে রইলো। তা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে টেনে গিলে ফেললেও রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)

রোযার মাকরূহ সমূহ

এখন রোযার মাকরূহ সমূহ বর্ণনা করা হচ্ছে, যে সব কাজ করলে রোযা বিশুদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু সেটার নূরানিয়্যাত চলে যায়।  প্রথমে তিনটি হাদীস শরীফ দেখুন, তারপর ফিকহ শাস্ত্রের বিধানাবলী আরয করা হবে।
১. হযরত সায়্যিদুনা আবু হুুরায়রা  رضى الله عنه  থেকে বর্ণিত, তাজদারে মদীনা, হযরত মুহাম্মদ   ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) খারাপ কথা ও খারাপ কাজ পরিহার করেনি, তার পানাহার ছেড়ে দেওয়া আল্লাহ তাআলার কাছে কোন প্রয়োজন নেই। (সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬২৮, হাদীস নং-১৯০৩)
২. হযরত সায়্যিদুনা আবু হুুরায়রা  رضى الله عنه  থেকে বর্ণিত, “তাজেদারে মদীনা সুরুরে কলবো সীনা হযরত মুহাম্মদ   ইরশাদ ফরমান, “রোযা হচ্ছে ঢাল, যতক্ষণ না সেটাকে ছিদ্র করে না দাও।” আরয করা হলে, “কোন জিনিষ দিয়ে ছিদ্র করা হয়?” ইরশাদ ফরমালেন, “মিথ্যা কিংবা গীবত দ্বারা।” (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-২য়, পৃ-৯৪, হাদীস নং-০৩)
৩. হযরত সায়্যিদুনা আমের ইবনে রবীআহ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُمْا  থেকে বর্ণিত, “আমি অনেকবার সরকারে ওয়ালা তাবার হযরত মুহাম্মদ   কে রোযা পালনকালে মিসওয়াক করতে দেখেছি।” (তিরমিযী, খন্ড-২য়, পৃ-১৭৬, হাদীস নং- ৭২৫)

রোযার মাকরূহ সমূহের ১২টি নিয়মাবলী

১. মিথ্যা, চোগলখোরী, গীবত, কুদৃষ্টি, গালিগালাজ করা, শরীয়তের অনুমতি ব্যতীত কারো মনে কষ্ট দেয়া ও দাড়ি মুন্ডানো ইত্যাদি কাজ এমনিতেতো অবৈধ ও হারাম বা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, রোযায় আরো বেশি হারাম। সেগুলোর কারণে রোযা মাকরূহ হয়ে যায়।
২. রোযাদারের জন্য কোন জিনিষকে বিনা কারণে স্বাদ গ্রহণ করা ও চিবুনো মাকরূহ। স্বাদ গ্রহণের জন্য ওযর হচ্ছে, যেমন কোন নারীর স্বামী বদ-মেযাজী তরকারী ইত্যাদিতে লবণ কমবেশি হলে রাগ করবে। এ কারণে স্বাদ গ্রহণে ক্ষতি
নেই। চিবুনোর জন্য ওযর হচ্ছে, এতোই ছোট শিশু আছে যে রুটি চিবুতে পারে না; এমন কোন নরম খাদ্যও নেই যা তাকে খাওয়ানো যাবে; না আছে কোন ঋতুস্রাব (**) কিংবা নিফাস সম্পন্না নারী অথবা এমন কেউ নেই, যে তা চিবিয়ে দেবে, তাহলে শিশুকে খাওয়ানোর জন্য রুটি ইত্যাদি চিবুনো মাকরূহ নয়। (আদ দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ- ৩৯৫) কিন্তু এ ক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বণ করবে। যদি কণ্ঠনালী দিয়ে কিছু নিচে নেমে যায় তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
** ঋতুস্রাব ও প্রসবোত্তরকালীন রক্তক্ষরণকালে (হায়য ও নিফাসসম্পন্না) নারীর জন্য রোযা, নামায ও তিলাওয়াত না-জায়িয ও গুনাহ্। নামায তার জন্য মাফ; কিন্তু পাক হয়ে যাবার পর রোযার কাযা আদায় করতে হবে।

স্বাদ গ্রহণ কাকে বলে?

স্বাদ গ্রহণের অর্থও তা নয়, যা আজকাল সাধারণ পরিভাষায় বলা হয়। অর্থাৎ আজকাল বলতে শোনা যায়, ‘কোন জিনিষের স্বাদ বুঝার জন্য তা থেকে কিছুটা খেয়ে নেয়া যাবে।’ এমন করা হলে মাকরূহ কিভাবে? বরং রোযাই ভেঙ্গে যাবে; এবং কাফফারার শর্তাবলী পাওয়া গেলে কাফফারাও অপরিহার্য হয়ে যাবে। স্বাদ নেয়ার অর্থ হচ্ছে-শুধু জিহ্বায় রেখে স্বাদ বুঝে নেবেন। আর সাথে সাথে তা থুথুুর সাথে ফেলে দেবেন, তা থেকে যেন কণ্ঠনালী দিয়ে কিছু নিচে যেতে না পারে।
৩. যদি কোন জিনিষ কিনলো আর সেটার স্বাদ দেখা জরুরী। কারণ, স্বাদ না দেখলে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। এমতাবস্থায় স্বাদ পরীক্ষা করতে ক্ষতি নেই, অন্যথায় মাকরূহ। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৫)
৪. স্ত্রীকে চুমু দেয়া ও আলিঙ্গন করা এবং স্পর্শ করা মাকরূহ নয়; অবশ্য যদি এ আশঙ্কা থাকে যে, বীর্যপাত হয়ে যাবে, কিংবা সহবাসে লিপ্ত হয়ে যাবে তাহলে করা যাবে না। আর দুধের বোঁটা ও জিহ্বা শোষণ করা রোযার মধ্যে নিঃশর্তভাবে
মাকরূহ। অনুরূপভাবে ‘মুবাশারাতে ফাহিশাহ (অর্থাৎ বিবস্ত্রাবস্থায় স্বামী-স্ত্রী পরস্পর যৌনাঙ্গ লাগানো মাকরূহ)*। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৬)
বিবাহ শাদীর নিয়্যত সম্পর্কিত বিষয় সমূহ জানার জন্য ফাতাওয়ায়ে রযবীয়্যাহ, খন্ড-২৩, পৃ- ৩৮৫-৩৮৬ তে ৪১, ৪২ নম্বর মাসআলা অধ্যয়ন করুন।
৫. গোলাপ কিংবা মুশক ইত্যাদির ঘ্রাণ নেয়া, দাড়ি ও গোঁফে তেল লাগানো ও সুরমা লাগানো মাকরূহ নয়। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৭)
৬. রোযা রাখা অবস্থায় যে কোন ধরণের আতরের ঘ্রাণ নেয়া যেতে পারে। আর কাপড়েও ব্যবহার করা যাবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৭)
৭. রোযা পালনকালে মিসওয়াক করা মাকরূহ নয় বরং অন্যান্য দিনগুলোতে যেমন সুন্নত তেমনি রোযায়ও সুন্নত। মিসওয়াকও শুষ্ক হোক কিংবা ভেজা, যদিও পানি দ্বারা নরম করে নেয়া হয়, সূর্য পশ্চিম দিকে হেলার পূর্বে করুক কিংবা পরে করুক, কোন সময় বা কোন অবস্থাতেই মাকরূহ নয়। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৯)
৮. বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে এ কথা প্রসিদ্ধ যে, রোযাদারের জন্য দুপুরের পর মিসওয়াক করা মাকরূহ। এটা আমাদের হানাফী মাযহাবের মাসআলা বিরোধী কথা। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৯)
৯. যদি মিসওয়াক চিবুলে আঁশ ছুটে যায়, স্বাদ অনুভূত হয়, এমন মিসওয়াক রোযা পালনকালে ব্যবহার করা উচিত নয়। (ফাতাওয়ায়ে রযবীয়্যাহ্ সংশোধিত, খন্ড-১০, পৃ-৫১১) যদি মিসওয়াকের কোন আঁশ কিংবা কোন অংশ কণ্ঠনালীর নিচে নেমে যায়, তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
১০. ওযু ও গোসল ব্যতীত ঠান্ডা পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে কুলি করা কিংবা নাকে পানি দেয়া অথবা ঠান্ডার খাতিরে গোসল করা বরং শরীরের উপর ভেজা কাপড় জড়ানো মাকরূহ নয়। অবশ্য পেরেশানীভাব প্রকাশের জন্য ভেজা কাপড় জড়ানো মাকরূহ, ইবাদত পালনে মনকে সঙ্কুচিত করা ভালো কথা নয়। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৯)
১১. কোন কোন ইসলামী ভাই বারংবার থুথুু ফেলতে থাকে। হয়তো সে মনে করে যে, রোযা পালনকালে থুথুু গিলে ফেলা উচিত নয়। মূলতঃ এমন নয়। অবশ্য, মুখে থুথুু একত্রিত করে গিলে ফেলা-এটাতো রোযা ছাড়া অন্য সময়েও অপছন্দনীয় কাজ। আর রোযা পালনকালে মাকরূহ। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-১২৯)
১২. রমযানুল মুবারকের দিনগুলোতে এমন কোন কাজ করা জায়িয নয়, যার কারণে এমন দূর্বলতা এসে যায় যে, রোযা ভেঙ্গে গেছে এমন ধারণা জন্মে যায়। সুতরাং রুটি তৈরীকারীর উচিত হচ্ছে, দুপুর পর্যন্ত রুটি পাকাবে, তারপর বিশ্রাম নেবে। (দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০০)
এ বিধান রাজমিস্ত্রি, মজদুর ও অন্যান্য পরিশ্রমী লোকদের জন্যও। বেশি দূর্বলতার সম্ভাবনা হলে কাজের পরিমাণ কমিয়ে নিন, যাতে রোযা সম্পন্ন করতে পারেন।

রোযা না রাখার ওযরসমূহ

এখন ওইসব অপরাগতার কথা বর্ণনা করা হচ্ছে, যেগুলোর কারণে রমযানুল মুবারকে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, অপারগতার কারণে রোযা মাফ নয়। ওই অপারগতা দূরীভূত হয়ে যাবার পর সেটার কাযা রাখা ফরয। অবশ্য, এ কাযার কারণে গুনাহ্ হবে না। যেমন, ‘বাহারে শরীয়ত’ এ ‘দুররে মুখতার’ এর বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সফর, গর্ভাবস্থায়, সন্তানকে স্তনের দুধ পান করানো, রোগ, বার্ধক্য, প্রাণ-নাশের ভয়, জোর-যবরদস্তি, পাগল হয়ে যাওয়া ও জিহাদ এ সবই রোযা না রাখার ওযর। এসব ওযরের কারণে যদি কেউ রোযা না রাখে, তবে সে গুনাহগার নয়। যদি কেউ প্রাণে মেরে ফেলার কিংবা কোন অঙ্গ কেটে ফেলার অথবা মারাত্মকভাবে প্রহারের বাস্তবিক পক্ষেই হুমকি দিয়ে বলে, “রোযা ভেঙ্গে ফেল।” আর রোযাদারও জানে যে, একথা যে বলছে সে যা বলছে তাই করে ছাড়বে, এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গা কিংবা না রাখা গুনাহ্ নয়। ‘জোর-যবরদস্তি মানে এটাই।’ (দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০২)

সফরের সংজ্ঞা

সফরের মধ্যেও রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। সফরের পরিমাণও জেনে নিন! সায়্যিদী ও মুরশিদী ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরত মওলানা শাহ আহমদ রযা খান رحمة الله عليه   এর গবেষণা অনুসারে শরীয়ত সম্মত সফরের পরিমাণ হচ্ছে- সাতান্ন মাইল তিন ফরলঙ্গ (অর্থাৎ প্রায় ৯২ কিলোমিটার)। যে কেউ এতটুকু দূরত্বে সফর করার উদ্দেশ্যে আপন শহর কিংবা গ্রামের বসতি থেকে দূরে যায়, সে তখন শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসাফির। তার জন্য রোযা কাযা করার অনুমতি রয়েছে। আর নামাযেও কসর করবে। মুসাফির যদি রোযা রাখতে চায় তবে রাখতে পারবে; কিন্তু চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামাযে কসর করা তার জন্য ওয়াজিব। কসর না করলে গুনাহগার হবে। অজ্ঞতাবশতঃ যদি পূর্ণ (চার) রাকআত পড়ে নেয়, তবে ওই নামাযকে পুনরায় পড়া ওয়াজিব। (ফাতাওয়ায়ে রযবীয়্যাহ্ সংশোধিত, খন্ড-৮ম, পৃ-২৭০)  অর্থাৎ জানা না থাকার কারণে আজ পর্যন্ত যতো নামাযই সফরে পূর্ণভাবে আদায় করেছে সেগুলোর হিসাব করে চার রাকআত ফরয কসরের নিয়্যতে দু দু রাকআত করে পুনরায় পড়তে হবে। হাঁ, মুসাফির মুকীম ইমামের পেছনে ফরয চার রাকআত পূর্ণ পড়তে হয়। সুন্নতসমূহ ও বিতরের নামায পুনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই। কসর শুধু যোহর, আসর ও ইশার ফরয রাকআত গুলোতেই করতে হয়। অর্থাৎ এগুলোতে চার ফরযের স্থানে দু’ রাকআত সম্পন্ন করা হবে। অবশিষ্ট সুন্নত সমুহ এবং বিতরের রাকআতগুলো পুরোপুরিই পড়তে হবে। অন্য কোন শহর কিংবা গ্রাম ইত্যাদিতে পৌঁছার পর যতক্ষণ ১৫ দিন থেকে কম সময়ের জন্য অবস্থান করার নিয়্যত করে নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ‘মুসাফির’ই বলা হবে এবং তার জন্য মুসাফিরের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে। আর যদি মুসাফির সেখানে পৌঁছে ১৫ দিন কিংবা আরো বেশি সময় অবস্থান করার নিয়্যত করে নেয়, তাহলে এখন মুসাফিরের বিধানাবলী শেষ হয়ে যাবে এবং তাকে ‘মুকীম’ বলা হবে। এখন তার রোযাও রাখতে হবে, নামাযেও কসর করবে না।

সামান্য অসুস্থতা কোন অপারগতা নয়

যদি কোন ধরনের অসুখ হয় এবং যদি এ অবস্থায় তার রোযা রাখলে রোগ বৃদ্ধি পাওয়ার বা দেরীতে সুস্থতা লাভ করার প্রবল ধারণা হয় তবে তার জন্য রোযা না রেখে পরবর্তীতে তা কাজা করার অনুমতি রয়েছে। (এর বিস্তারিত বর্ণনা সামনে আসছে) কিন্তু আজকাল দেখা যায় মানুষ সামান্য সর্দি, জ্বর, মাথা ব্যাথার কারণে রোযা ছেড়ে দেয় অথবা আল্লাহরই পানাহ রোযা রেখে ভেঙ্গে ফেলে, এ রকম কখনো না হওয়া চাই, যদি কেউ কোন বিশুদ্ধ শরয়ী কারণ ছাড়া রোযা রাখা ছেড়ে দেয়, যদি ও সে পরবর্তীতে সারাজীবনও রোযা রাখে তবুও ঐ একটি রোযার ফযীলত কখনো পাবে না।  যেহেতু ‘রোযা না রাখার ওযরসমূহ’ এর বিস্তারিত বর্ণনা সামনে করা হবে, সেহেতু তিনটি বরকতময় হাদীস বর্ণনা করা হচ্ছে:

সফরে ইচ্ছা হলে, রোযা রাখো, নতুবা ছেড়ে দাও

(১) উম্মুল মুমিনীন হযরত সায়্যিদাতুনা আয়িশা সিদ্দীকা رضى الله عنها বর্ণনা করেছেন, “হযরত সায়্যিদুনা হামযা ইবনে আমর আসলামী رضى الله عنه বেশি রোযা রাখতেন। তিনি মদীনার তাজেদার, হযরত মুহাম্মদ   কে জিজ্ঞাসা করে আরয করলেন, “আমি কি সফরে রোযা রাখবো?” হুযুর  ﷺ  ইরশাদ করলেন, “ইচ্ছা হলে রাখো, আর ইচ্ছা না হলে রেখোনা।” (সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬৪০, হাদীস নং-১৯৪৩)
(২) হযরত সায়্যিদুনা আবু সাঈদ খুদরী رضى الله عنه  বলেন, “১৬ রমযানুল মুবারক সারওয়ারে কাইনাত হযরত মুহাম্মদ ﷺ   এর সাথে আমরা জিহাদে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রোযা রেখেছিলেন, আর কেউ কেউ রাখেননি। তখন রোযাদারগণ যারা রোযা রাখেনি তাদের প্রতি দোষারোপ করেনি এবং যারা রোযাদার না তারাও রোযাদারদের বিরূদ্ধে দোষারূপ করেন নি, একে অপরের বিরুধিতা করেন নি।” (মুসলিম শরীফ, খন্ড-১ম, পৃ-৫৬৪, হাদীস নং-১১১৬)
(৩) হযরত সায়্যিদুনা আনাস ইবনে মালিক কাবী رضى الله عنه  থেকে বর্ণিত, মদীনার তাজদার হযরত মুহাম্মদ ﷺ  ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা’আলা মুসাফির থেকে অর্ধেক নামায ক্ষমা করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামায দুরাকআত পড়বে।) আর মুসাফির ও স্তন্যদাত্রী এবং গর্ভবতীর রোযা ক্ষমা করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ: তখন রোযা না রাখার অনুমতি দিয়েছেন। পরবর্তীতে সে পরিমাণ রোযা কাযা আদায় করবে।) (তিরমিযী, খন্ড-২য়, পৃ-১৭০, হাদীস-১৭৫) (কিন্তু ওই অপারগতা শেষ হয়ে যাবার পর প্রতিটি রোযার পরিবর্তে একটি করে রোযা কাযা করতে হবে।)
__________________________
লিখাটি আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত রযমান মাসের বিস্তারিত মাসাইল সম্পর্কিত “রমযানের ফযিলত” নামক কিতাবের ১৮১-১৮৮ নং পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত। কিতাবটি নিজে কিনুন, অন্যকে উপহার দিন।

▪ রোযার কাযা ও কাফফারার বিধানাবলী



১. এটা ধারণা ছিলো যে, সেহরীর সময় শেষ হয়নি। তাই পানাহার করেছে, স্ত্রী সহবাস করেছে। পরে জানতে পারলো যে, তখন সেহরীর সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় রোযা হয়নি, এ রোযার কাযা করা জরুরী। অর্থাৎ ওই রোযার পরিবর্তে একটা রোযা রাখতে হবে। (রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৮০)
২. খানা খাওয়ার জন্য কঠোরভাবে বাধ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ শরীয়ত সম্মত বাধ্যবাধকতা (কেউ হত্যা কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলার হুমকি দিয়ে বললো, “রোযা ভেঙ্গে ফেল।” যদি রোযাদার নিশ্চিতভাবে মনে করে যে, সে যা বলছে তা করেই ছাড়বে। তাহলে শরীয়তসম্মত বাধ্য করণ পাওয়া গেলো। এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে এ রোযার কাযা করে দেয়া অপরিহার্য। এখন যেহেতু বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তাই শুধু কাযা ওয়াজিব হবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০২)
৩. ভুলবশতঃ পানাহার করেছে কিংবা স্ত্রী সহবাস করেছিলো, অথবা এমনভাবে দৃষ্টি করেছে যে, বীর্যপাত হয়েছে, কিংবা স্বপ্নদোষ হয়েছে, অথবা বমি হয়েছে, এসব অবস্থায় এ ধারণা করল যে, রোযা ভেঙ্গে গেছে, তাই এখন স্বেচ্ছায় পানাহার করে নিল। কাজেই, এখন শুধু কাযা ফরয হবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৫)
৪. রোযারত অবস্থায় নাকে ঔষধ দিলে রোযা ভেঙ্গে যায়। এর কাযা অপরিহার্য। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৬)
৫. পাথর, কঙ্কর (এমন) মাটি যা সাধারণত খাওয়া হয়না, তুলা, ঘাস, কাগজ ইত্যাদি এমন জিনিষ আহার করলো, যে গুলোকে মানুষ ঘৃণা করে, এ গুলোর কারণেতো রোযা ভেঙ্গে গেলো, কিন্তু শুধু কাযা করতে হবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৭)
৬. বৃষ্টির পানি কিংবা শিলাবৃষ্টি নিজে নিজেই কণ্ঠনালীতে ঢুকে গেলো। তবুও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা অপরিহার্য হবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৮)
৭. খুব বেশি ঘাম কিংবা চোখের পানি বের হলে ও তা গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ওয়াজিব হয়। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৮)
৮. ধারণা করলো যে এখনো রাত বাকী আছে তাই সেহেরী খেতে থাকল; পরে জানতে পারল সাহারীর সময় শেষ, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে। (রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৮০)
৯. একইভাবে ধারণা করলো যে সূর্য ডুবে গেছে, পানাহার করে নিল। পরক্ষণে জানতে পারলো যে, সূর্য ডুবেনি। এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে যাবে। কাযা করে নিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৮০)
১০. যদি সূর্য অস্তমিত হবার পূর্বেই সাইরেনের আওয়াজ ধ্বনিত হয়ে ওঠে কিংবা মাগরিবের আযান শুরু হয়ে যায়, আর আপনি রোযার ইফতার করে নেন এবং পরে আপনি জানতে পারলেন যে, সাইরেন কিংবা আযান সময়ের পূর্বেই শুরু হয়েছিলো। এতে যদিও আপনার দোষ থাকুক বা নাই থাকুক, তবুও রোযা ভেঙ্গে গেছে, কাযা করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৮৩)
১১. আজকাল যেহেতু উদাসীনতার ছড়াছড়ি, সেহেতু প্রত্যেকের উচিত নিজেই নিজের রোযার হিফাযত করা। সাইরেন, রেডিও টিভির ঘোষণা বরং মসজিদের আযানকেও যথেষ্ট বলে মনে করার পরিবর্তে নিজেই সাহারী ও ইফতারের সময় সঠিকভাবে জেনে নিন।
১২. ওযু করছিলেন। নাকে পানি দিলেন এবং তা মগজ পর্যন্ত ওঠে গেলো কিংবা কণ্ঠনালী দিয়ে নিচে নেমে গেলো। রোযাদার হবার কথাও স্মরণ ছিলো। এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা অপরিহার্য হবে। হাঁ, তখন যদি রোযাদার হবার কথা স্মরণ না থাকে তবে রোযা ভাঙ্গবে না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০২)

কাফফারার বিধানাবলী

রমযানুল মুবারকের রোযা রেখে কোন সঠিক অপারগতা ছাড়া জেনে বুঝে ভেঙ্গে ফেললে কোন কোন অবস্থায় কাযা, আর কোন কোন অবস্থায় কাযার সাথে কাফফারাও অপরিহার্য হয়ে যায়। এখানে তার বিধানাবলী বর্ণনা করা হবে। তবে এর পূর্বে জেনে নিন কাফফারা কি?

রোযার কাফফারার পদ্ধতি

রোযা ভাঙ্গার কারণে কাফফারা হচ্ছে- সম্ভব হলে একটা বাঁদী (ক্রীতদাসী) কিংবা গোলাম (ক্রীতদাস) আযাদ করবে। তা করতে না পারলে, যেমন-তার নিকট না ক্রীতদাসী বা ক্রীতদাস আছে, না এত সম্পদ আছে যে, ক্রয় করতে পারবে,
অথবা অর্থকড়ি তো আছে, কিস্তু দাস-দাসী পাওয়া যাচ্ছে না, যেমন-আজকাল দাস-দাসী পাওয়া যায় না, তাহলে ধারাবাহিকভাবে দু’মাস অর্থাৎ ষাটটি রোযা রাখবে। তাও যদি সম্ভব না হয়, তবে ষাটজন মিসকীনকে দু’বেলা পেট ভরে খানা খাওয়াবে। এক্ষেত্রে এটা জরুরী যে, যাকে এক বেলা খাবার খাওয়েছে, তাকেই দ্বিতীয় বেলা খাবার খাওয়াবে। এটাও হতে পারে যে, ষাটজন মিসকীনকে একেকটা সাদকাই ফিতর, অর্থাৎ প্রায় ২ কিলো ৫০ গ্রাম পরিমাণ গম অথবা এর মূল্য প্রদান করবে। একজন মিসকীনকে একত্রে ষাট সদকা-ই-ফিতর দিতে পারবে না। হাঁ, এটা হতে পারে
যে, একজন মিসকীনকে ষাট দিন যাবত প্রতিদিন একেকটা সদকা-ই-ফিতর দেবে। রোযাগুলো পালন কালে (কাফফারা আদায়কালীন সময়ে) যদি মাঝখানে একটি রোযাও ছুটে যায়, তবে পুনরায় শুরু থেকে ষাটটা রোযা রাখতে হবে; পূর্বেকার রোযাগুলো হিসাবে ধরা হবে না, যদিও উনষাটটা রেখে থাকে; চাই রোগ ইত্যাদি কোন ওযরের কারণেই ছুটে যাক না কেন? হাঁ, অবশ্য নারীর যদি হায়েয এসে যায়, তবে হায়যের কারণে রোযা ছুটে গেলে, সেটাকে বিরতি হিসেবে গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ হায়যের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রোযাগুলো মিলে ষাটটি পূর্ণ হয়ে গেলে কাফফারা আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯০) কেউ রাত থেকে রোযার নিয়্যত করেছে, তারপর সকালে কিংবা দিনের কোন সময় বরং ইফতারের এক মুহুর্ত পূর্বে কোন বিশুদ্ধ অপারগতা ব্যতিরেকেই এমন কোন বস্তু দ্বারা, যাকে মানুষ ঘৃণা করে না। (যেমন-খাদ্য, পানি, চা, ফলমূল, বিস্কুট, শরবত, মধু, মিষ্টি ইত্যাদি) ইচ্ছাকৃতভাবে খেয়ে রোযা ভেঙ্গে ফেলেছে, তবে রমযান শরীফের পর ওই রোযার কাযার নিয়্যতে একটা রোযাও রাখতে হবে। এবং সাথে কাফফারাও দিতে হবে, যার পদ্ধতি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

কাফফারা সম্পর্কে ১১ টি নিয়মাবলী

১. রমযানুল মুবারকে কোন বিবেকবান, বালেগ, মুকীম (অর্থাৎ মুসাফির নয় এমন লোক) রমযানের রোযা আদায় করার নিয়্যতে রোযা রাখলো। আর কোন বিশুদ্ধ অপারগতা ব্যতিরেকে (জেনেবুঝে) স্ত্রী সঙ্গম করলে কিংবা করালে। অথবা অন্য কোন স্বাদের কারণে কিংবা ঔষধ হিসেবে খেলো বা পান করলো। এমতাবস্থায় রোযা ভেঙ্গে যাবে। তার উপর কাযা ও কাফফারা উভয়ই অপরিহার্য হবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৮৮)
২. যেখানে রোযা ভাঙ্গলে কাফফারা অপরিহার্য হয়, সেখানে পূর্ব শর্ত হচ্ছে-রাত থেকেই রমযানের রোযার নিয়্যত করে নেয়া। যদি দিনে নিয়্যত করে এবং ভেঙ্গে ফেলে, তাহলে কাফফারা অপরিহার্য নয়, শুধু কাযা যথেষ্ট। (আল জাওহারাতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৮০)
৩. মুখ ভরে বমি হলে কিংবা ভুলবশতঃ আহার করলে কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে। এসব অবস্থায় তার জানা ছিলো যে, রোযা ভাঙ্গে নি, তবুও সে আহার করে নিয়েছে, এমতাবস্থায় কাফফারাঅপরিহার্য নয়। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৭৫)
৪. স্বপ্নদোষ হয়েছে আর জানা ছিলো যে, তার রোযা ভাঙ্গেনি, তারপরেও আহার করে নিয়েছে, তবে কাফফারা অপরিহার্য। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৭৫)
৫. নিজের থুু ফেলে পুনরায় তা চেঁটে নিলো। কিংবা অপরের থুু গিলে ফেললে। কিংবা দ্বীনি কোন সম্মানিত (বুযুর্গ) ব্যক্তির থুু তাবাররুক হিসেবে গিলে ফেললে কাফফারা অপরিহার্য। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩) তরমুজের ছিলকা খেয়েছে। তা শুষ্ক হোক কিংবা এমন হয় যে, লোকজন তা খেতে ঘৃণা করে, তাহলে কাফফারা দিতে হবে না, অন্যথায় জরুরী। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০২)
৬. চাউল, কাঁচা ভুট্টা, মশুর কিংবা মুগ ডাল খেয়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায় কাফফারা অপরিহার্য নয়। এ বিধান কাঁচা যবেরও। কিন্তু ভুনা হলে কাফফারা অপরিহার্য। (আলমগীরী, খণ্ড-১ম, পৃ-২০২)
৭. সাহারীর লোকমা মুখে ছিলো। সুবহে সাদিকের সময় হয়ে গেছে কিংবা  ভুলবশতঃ খাচ্ছিলো, লোকমা মুখে ছিলো, হঠাৎ স্মরণ হয়ে গেলো, তারপরেও গিলে ফেলেছে, এ দুটি অবস্থায় কাফফারা ওয়াজিব। আর যদি লোকমা মুখ থেকে
বের করে পুনরায় খেয়ে ফেললো, তাহলে শুধু কাযা ওয়াজিব, কাফফারা নয়। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
৮. পালাক্রমে জ্বর আসতো। আজ পালার দিন ছিলো। তাই জ্বর আসবে ধারণা করে ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা ভেঙ্গে ফেললো। তাহলে এমতাবস্থায় কাফফারা থেকে অব্যাহতি মিলবে। (অর্থাৎ: কাফফারা প্রয়োজন নেই।) অনুরূপভাবে, নারীর নির্ধারিত তারিখে হায়য (ঋতুস্রাব) হতো। আজ ঋতুস্রাবের দিন ছিলো। সুতরাং স্বেচ্ছায় রোযা ভেঙ্গে ফেললো; কিন্তু হায়য আসেনি। তাহলে, কাফফারা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। (অর্থাৎ কাফফারা প্রয়োজন নেই।) (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯১)
৯. যদি দুটি রোযা ভাঙ্গে তবে দুটির জন্য দুটি কাফফারা দেবে, যদিও প্রথমটির কাফফারা এখনো আদায় করেনি। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৯১) যখন দুইটি দুই রমযানের হয়। আর যদি উভয় রোযা এক রমযানের হয়, প্রথমটার কাফফারা আদায় করা না হয়, তবে একটি কাফফারা উভয় রোযার জন্য যথেষ্ট।
(আল-জাওহারাতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-০১, পৃ-১৮২)
১০. কাফফারা অপরিহার্য হবার জন্য এটাও জরুরী যে, রোযা ভাঙ্গার পর এমন কোন কাজ কাফফারা হয়নি, যা রোযার পরিপন্থি (রোযা ভঙ্গকারী), কিংবা বিনা ইচ্ছায় এমন কোন কাজ পাওয়া যায়নি, যার কারণে রোযা ভাঙ্গার অনুমতি পাওয়া যেতো, উদাহরণস্বরূপ, ওই দিন নারীর হায়য কিংবা নিফাস এসে গেছে, কিংবা রোযা ভাঙ্গার পর ওই দিনই এমন রোগ হয়েছে, যাতে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে, তাহলে কাফফারা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং সফরের কারণে অব্যাহতি পাওয়া যাবে না, যেহেতু এটা ইচ্ছাকৃত কাজ। (আল-জাওহারাতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৮১)
১১. যে অবস্থায় রোযা ভাঙ্গলে কাফফারা দেয়া আবশ্যক হয়না, এতে শর্ত যে, একবার এই রকম হয়েছে এবং নাফরমানীর ইচ্ছা করে না, যদি নাফরমানীর ইচ্ছা থাকে তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪৪০)

__________________________
লিখাটি আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত রযমান মাসের বিস্তারিত মাসাইল সম্পর্কিত “রমযানের ফযিলত” নামক কিতাবের ১৮১-১৮৮ নং পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত। কিতাবটি নিজে কিনুন, অন্যকে উপহার দিন।

▪ রোযা না রাখার অনুমতি সম্বলিত ৩৩টি বিধান [যেসব কারণে রোজা না রাখা জায়েজ]




১. মুসাফিরের জন্য রোযা রাখা ও না রাখার মধ্যে নিজের স্বাধীনতা রয়েছে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০৩)
২. যদি স্বয়ং ওই মুসাফিরের জন্য এবং তার সফরসঙ্গীদের জন্য রোযা ক্ষতিকর না হয়, তবে সফরে রোযা রাখা উত্তম। আর উভয়ের কিংবা তাদের কোন একজনের জন্য ক্ষতিকারক হয়, তাহলে রোযা না রাখা উত্তম। (দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০৫)

৩. মুসাফির ‘দ্বাহওয়ায়ে কুবরা* এর পূর্বক্ষণে মুকীম হিসেবে অবস্থান করলো, এখনো পর্যন্ত কিছুই খায়নি, এমতাবস্থায় রোযার নিয়্যত করে নেয়া ওয়াজিব। (আল-জাওয়াহারাতুন নাইয়েরাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৮৬) যেমন, আপনার ঘর বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ শহর চট্টগ্রামে। আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হলেন। সকাল দশটার সময় পৌঁছে গেলেন। আর সোবহে সাদিক থেকে রাস্তায় কোন কিছু পানাহার করেননি। এমতাবস্থায় রোযার নিয়্যত করে নিন।
*দ্বাহওয়ায়ে কুবরা এর সংজ্ঞা রোজার নিয়্যতের বর্ণনার মধ্যে পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।
৪. দিনে যদি সফর করেন, তবে ওই দিনের রোযা না রাখার জন্য আজকের সফর ওযর নয়। অবশ্য, যদি সফরের মধ্যভাগে ভঙ্গ করেন তবে কাফফারা অপরিহার্য হবে না, কিন্তু গুনাহ্ অবশ্যই হবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৬) আর রোযা কাযা করা ফরয হবে।
৫. যদি সফর শুরু করার পূর্বে ভেঙ্গে ফেলে, তারপর সফর করে, তাহলে (যদি কাফফারার শর্তাবলী পাওয়া যায়, তবে) কাফফারাও অপরিহার্য হবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৬)
৬. যদি দিনের বেলায় সফর শুরু করে, (সফরের মধ্যভাগে রোযা না ভাঙ্গে) আর ঘরে কিছু জিনিষ ভুলে ফেলে যাওয়ায়, সেটা নেয়ার জন্য ফিরে আসে, এখানে এসে যদি রোযা ভেঙ্গে ফেলে, তবে (শর্তাবলী পাওয়া গেলে) কাফফারাও ওয়াজিব হবে। যদি সফরের মাঝখানে ভেঙ্গে ফেলতো তবে শুধু কাযা ফরয হতো। যেমন, ৪ নং নিয়মাবলীতে উল্লেখ করা হয়েছে। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খন্ড-০১, পৃ-২০৭)
৭. কাউকে রোযা ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে, তাহলে রোযাতো ভাঙ্গতে পারে, কিন্তু ধৈর্যধারণ করলে সাওয়াব পাবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০২)
৮. সাপ দংশন করেছে। আর প্রাণ বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে। এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০২)
৯. যেসব লোক এসব অপারগতার কারণে রোযা ভেঙ্গে ফেলে, তাদের উপর সেগুলোর কাযা দেয়া ফরয। আর এসব কাযা রোযার মধ্যে তারতীব ফরয নয়। যদি ওই রোযাগুলো কাযা করার পূর্বে নফল রোযা রাখে তাহলে সেগুলো নফলই হবে। কিন্তু বিধান হচ্ছে অপারগতা (ওযর) দূরীভূত হবার পর পরবর্তী রমযানুল মুবারক আসার পূর্বেই কাযা রোযা রেখে নেয়া। হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, “যার উপর বিগত রমযানুল মুবারকের রোযা বাকী থেকে যায়, আর সে তা পালন না করে, তার এ রমযানুল মুবারকের রোযা কবুল হবে না।” (মাজমাউয যাওয়ায়িদ, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৫) যদি সময় অতিবাহিত হতে থাকে, কিন্তু কাযা রোযা রাখেনি, শেষ পর্যন্ত পরবর্তী রমযান শরীফ এসে গেছে, এমতাবস্থায় কাযা রোযা রাখার পরিবর্তে প্রথমে এ রমযানুল মুবারকের রোযা রাখবে। এমনকি রোগী নয় এমন লোক ও মুসাফির কাযার নিয়্যত করলো, তবুও তা কাযা হলো না, বরং তা ওই রমযান শরীফের রোযাই হলো। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০৫)
১০. গর্ভবর্তী কিংবা স্তনের দুধ পান করায় এমন নারী, নিজের কিংবা শিশুর প্রাণ নাশের সম্ভাবনা থাকে, তবে রোযা রাখবে না। যদি মা গর্ভবতী হোক কিংবা দুধ পানকারীনী মা যদিও রমজানুল মুবারকের মধ্যে দুধপান করানোর চাকুরী করুক। (দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০৩)
১১. ক্ষুধা কিংবা পিপাসা এতোই তীব্র হলো যে, প্রাণ নাশের ভয় নিশ্চিত হয়ে গেছে, কিংবা বিবেকশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবার আশংকা করা হয়, তাহলে রোযা রাখবে না। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০২)
১২. রোগীর রোগ বেড়ে যাওয়ার বা রোগ আরোগ্য হবার, অথবা সুস্থ লোক রোগী হয়ে পড়ার অধিকাংশ ধারণা হয়ে যায়, তবে সেদিনের রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। (তবে পরবর্তীতে কাযা রেখে নেবে।) (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০৩)
১৩. এসব অবস্থায় ‘অধিকাংশ ধারণার’ শর্তারোপ করা হয়েছে, নিছক সন্দেহ যথেষ্ট নয়। ‘অধিকাংশ ধারণার তিনটি ধরণ রয়েছে: ১. যদি তার প্রকাশ্য চিহ্ন পাওয়া যায়, ২. যদি ওই লোকটির নিজস্ব অভিজ্ঞতা থাকে এবং ৩. কোন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মুসলমান ফাসিক নয় এমন চিকিৎসক তাকে বলে আর যদি এমন হয় যে, কোন চিহ্ন নেই, অভিজ্ঞতাও নেই, আর না এ ধরণের চিকিৎসক তাকে বলেছে, বরং কোন কাফির কিংবা ফাসিক চিকিৎসকের কথায় রোযা ভেঙ্গে ফেলেছে তাহলে (শর্তাবলী পাওয়া গেলে) কাযার সাথে কাফফারাও অপরিহার্য হবে। (রদ্দে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪০৪)
১৪. হায়েয কিংবা নিফাসের (যথাক্রমে মাসিক ঋতুস্রাব ও প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ) অবস্থায় নামায ও রোযা পালন করা হারাম। কুরআনের তিলাওয়াত কিংবা কুরআনে পাকের পবিত্র আয়াত অথবা সেগুলোর তরজমা স্পর্শ করা সবই হারাম। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-২য়, পৃ-৮৮ ও ৮৯)
১৫. ‘হায়েয’ ও ‘নিফাস’ সম্পন্ন নারীর জন্য স্বাধীনতা রয়েছে গোপনে খাবে কিংবা প্রকাশ্যে। রোযাদারের মতো থাকা তার জন্য জরুরী নয়। (আল জাওহারাতুন নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৮৬)
১৬. কিন্তু গোপনে খাওয়া উত্তম। বিশেষ করে হায়যসম্পন্নার জন্য। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-১৩৫)
১৭. ‘শায়খে ফানী’ অর্থাৎ ওই বয়োবৃদ্ধ লোক, যার বয়স এতোই ভারী হয়েছে যে, এখন ওই বেচারা দিন দিন দূর্বলই হতে চলেছে, যখন সে একেবারেই রোযা রাখতে অক্ষম হয়ে যায়, অর্থাৎ না এখন রোযা রাখতে পারছে, না ভবিষ্যতে রোযা রাখার শক্তি আসার আশা আছে, এমতাবস্থায় তার জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। সুতরাং প্রতিটি রোযার পরিবর্তে (ফিদিয়া স্বরূপ) এক ‘সদকায়ে ফিতর’* পরিমাণ মিসকিনকে দিয়ে দেবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১০)
* ‘সাদকায়ে ফিতর’ হচ্ছে সোয়া দুই সের অর্থাৎ প্রায় দুই কিলো পঞ্চাশ গ্রামের সমান আটা, অথবা তার মূল্য পরিমাণ টাকা।
১৮. যদি এমন বয়স্ক হয় যে গরম অবস্থায় রোযা রাখতে অপারগ, তাহলে রাখবে না। কিন্তু শীতে রাখা ফরয। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪৭২)
১৯. যদি ফিদিয়া দেয়ার পর রোযা রাখার শক্তি এসে যায়, তবে প্রদত্ত ফিদিয়া নফল সদকা হয়ে গেলো, কিন্তু ওই রোযাগুলোর কাযা রেখে নেবেন। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৭)
২০. এ স্বাধীনতা রয়েছে যে, চাই রমযানের শুরুতে পুরো রমযানের ফিদিয়া এক সাথে দিয়ে দিক কিংবা শেষ ভাগে দিক। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৭)
২১. ফিদিয়া দেয়ার সময় এটা জরুরী নয় যে, যতোটা ফিদিয়া হবে ততোটা মিসকিনকে আলাদা আলাদাভাবে দেবে, বরং একই মিসকিনকে কয়েকদিনের ফিদিয়াও দেয়া যাবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ- ৪১০)
২২. নফল রোযা ইচ্ছাকৃতভাবে শুরু করার পর পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। ভেঙ্গে ফেললে কাযা ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১১)
২৩. যদি আপনি এ ধারণা করে রোযা রাখলেন যে, আপনার দায়িত্বে কোন কাযা রোযা রয়ে গেছে, কিন্তু রোযা শুরু করার পর জানতে পারলেন যে, আপনার উপর কোন প্রকারের কোন রোযা কাযা নেই। এখন যদি তাৎক্ষণিকভাবে ভেঙ্গে ফেলেন, তবে কোন কিছুই নেই। আর যদি একথা জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে না ভাঙ্গেন, তবে পরে ভাঙ্গতে পারবেন না। ভাঙ্গলে কাযা ওয়াজিব হবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১১)
২৪. নফল রোযা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভাঙ্গেনি, বরং অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভেঙ্গে গেছে। যেমন- রোযা পালন কালে মহিলাদের হায়েয এসে গেলো, তবুও কাযা ওয়াজীব। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩, পৃঃ-৪১২)
২৫. ঈদুল ফিতরের একদিন কিংবা ঈদুল আযহার চারদিন, অর্থাৎ ১০, ১১, ১২ ও ১৩ ই যিলহাজ্জ থেকে কোন একটি দিনের নফল রোযা রাখলে, এ রোযাটি পূর্ণ করা ওয়াজিব নয় কেননা এ পাঁচ দিনে রোযা রাখা হারাম ভঙ্গ করলে কাযা
ওয়াজিব হবে না; বরং সেটা ভেঙ্গে ফেলাই ওয়াজিব। যদি এ দিনগুলোতে রোযা রাখার মান্নত মানেন, তাহলে মান্নত পূরণ করা ওয়াজিব। কিন্তু ওই দিনগুলোতে নয়, বরং অন্যান্য দিনে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১২)
২৬. নফল রোযা বিনা ওযরে ভেঙ্গে ফেলা না জায়িয। মেহমানের সাথে যদি না খায় তবে তার খারাপ লাগবে, অনুরূপভাবে, মেহমান না খেলে মেহমান মনে কষ্ট পাবেন। সুতরাং নফল রোযা ভাঙ্গার জন্য এটা একটা ওযর। سُبْحٰنَ الله عَزَّوَجَلّ শরীয়তে মুসলমানের সম্মান করার ব্যাপারে কতই গুরুত্ব রয়েছে) এ শর্তে যে, তার পূর্ণ ভরসা আছে যে, সে তা পুনরায় রেখে নেবে। আর দ্বি-প্রহর এর পূর্বে ভাঙ্গতে পারবে, পরে নয়। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৮)
২৭. দা’ওয়াতের কারণে “দ্বাহওয়ায়ে কুবরা” এর পূর্বে রোযা ভেঙ্গে ফেলা যাবে যখন মেহমান শুধুমাত্র তার উপস্থিতিতে রাজী না হন বরং তার না খাওয়ার কারণে নারাজ হন। তবে শর্ত হচ্ছে তার পূর্ণ ভরসা আছে যে, সে তা পুনরায় রেখে নেবে, এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গতে পারবে এবং এটার কাযা আদায় করবে। কিন্তুু যদি দা’ওয়াতকারী তার শুধুমাত্র উপস্থিতিতে রাজী হয়ে যান এবং তার না খাওয়াতে নারাজ না হন তবে রোযা ভঙ্গ করার অনুমতি নেই।
(ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৮, কুয়েটা)
২৮. নফল রোযা সূর্য পশ্চিম দিকে হেলার পর মাতাপিতা নারায হলে ভাঙ্গতে পারে। এমতাবস্থায় আসরের পূর্ব পর্যন্ত ভাঙ্গতে পারে, আসরের পরে পারবে না। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৪)
২৯. নারী তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া নফল, মান্নত ও শপথের কাফফারার রোযা রাখবে না। রেখে নিলে স্বামী ভাঙ্গিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ভাঙ্গলে কাযা ওয়াজিব হবে। আর সেটার কাযা করার সময়ও স্বামীর অনুমতির দরকার হবে। কিংবা স্বামী ও তার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে, অর্থাৎ তালাকে বাইন* দিয়ে দিলে,  কিংবা মৃত্যু হয়ে গেলে, অথবা রোযা রাখলে স্বামীর কোন ক্ষতি না হলে, যেমন সে সফরে গেলে কিংবা অসুস্থ থাকলে, অথবা ইহরাম অবস্থায় থাকলে, এসব অবস্থায় অনুমতি ছাড়াও ক্বাযা রাখতে পারবে; এমনকি সে নিষেধ করলেও স্ত্রী রেখে দিতে পারবে। অবশ্য ওই দিনগুলোতে নফল রোযা স্বামীর অনুমতি ছাড়া রাখতে পারে না। (রদ্দে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৫)
(*তালাকে বাইন ওই তালাককে বলে, যার কারণে স্ত্রী বিবাহ বন্ধন থেকে বেরিয়ে যায়। এখন স্ত্রী পুনরায় স্বামীকে গ্রহণ করতে পারে না। এখন স্বামী তার স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করতে পারবে না।)
৩০. রমযানুল মুবারক ও রমযানুল মুবারকের কাযার জন্য স্বামীর অনুমতির কোন প্রয়োজন নেই, বরং সে নিষেধ করলেও রাখবে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৫)
৩১. আপনি যদি কারো কর্মচারী হোন, কিংবা তার নিকট শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, তাহলে তার অনুমতি ছাড়া নফল রোযা রাখতে পারেন না। কেননা, রোযার কারণে কাজে অলসতা আসবে। অবশ্য, রোযা রাখা সত্ত্বেও যদি আপনি নিয়ম-মাফিক কাজ করতে পারেন, তার কাজে কোনরূপ ত্রুটি না হয়, তাহলে নফল রোযার জন্য অনুমতির দরকার নেই। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৬)
৩২. নফল রোযার জন্য মেয়ে পিতা থেকে, মা পুত্র থেকে এবং বোন ভাই থেকে অনুমতি নেয়ার দরকার নেই। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৪১৬)
৩৩. মাতা-পিতা যদি মেয়েকে নফল রোযা রাখতে নিষেধ করে এ কারণে যে, তার রোগের আশঙ্কা আছে, তবে মাতাপিতার কথা মানবে। (রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ- ৪১৬)

__________________________
লিখাটি আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী কর্তৃক লিখিত রযমান মাসের বিস্তারিত মাসাইল সম্পর্কিত “রমযানের ফযিলত” নামক কিতাবের ১৮১-১৮৮ নং পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত। কিতাবটি নিজে কিনুন, অন্যকে উপহার দিন।










Post a Comment

نموذج الاتصال